জেনারেল তারেক সিদ্দিকীর কোটি টাকার এনআইডি দুর্নীতি ফাঁস - দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ
নোটিশ:
শিরোনামঃ
তারবিহীন বিদ্যুৎ আর কল্পবিজ্ঞান নয়, বাস্তব হলো টেসলার স্বপ্ন বাংলাদেশ থেকে বিশ্ব দরবারে “কর্মঠ”: অ্যাকাউন্টিঙে বাজিমাত গাজী জিশানের আজ ‘জুলাই শহীদ দিবস’ ভুয়া ফটোকার্ডে ভুগছে গণমাধ্যম, পথ দেখাচ্ছে সাবাস বাংলাদেশ এর স্মার্ট ফটোকার্ড  আসিফ আদনানদের নামে জিহাদি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে মামলা: আবারও জঙ্গী কার্ড? ভাড়ার তর্কে ইবি ছাত্রীকে মারধরের অভিযোগ, জনি পরিবহনের বাস আটক টিটিপি সংশ্লিষ্টতার ধুয়ো তুলে ইসলামপন্থী যুবকদের মামলা-গ্রেফতার হয়রানি: জঙ্গী নাটকের নতুন অধ্যায় ইউটিউবের বড় নীতিমালা পরিবর্তন – মৌলিকতা ছাড়া আর আয় নয় প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদে দ্রুত নিয়োগের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার বিদেশে পড়াশোনার নামে শত কোটি টাকা আত্মসাৎ, ক্যামব্রিয়ান চেয়ারম্যান বাশার ১০ দিনের রিমান্ডে

জেনারেল তারেক সিদ্দিকীর কোটি টাকার এনআইডি দুর্নীতি ফাঁস

ডেস্ক রিপোর্ট
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০২৫
  • ৫৬ বার দেখা হয়েছে

দেশের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার, ঘুষ লেনদেন, আত্মীয়প্রীতি ও প্রভাব খাটানোর এক ভয়াবহ অনুসন্ধান উন্মোচন করল ‘নেত্র নিউজ’।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে একটি বৈঠকে ফরাসি প্রযুক্তি কোম্পানি ওবেরথার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় এক রহস্যময় ব্যক্তির, যার ছদ্মনাম ছিল ‘মি. জি’। তবে প্রকৃতপক্ষে তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিফেন্স ও সিকিউরিটি উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক আহমেদ সিদ্দিকী। বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রকল্প নিয়ে কোটি কোটি টাকার ঘুষ লেনদেনের এ ঘটনা বিশ্বব্যাংক, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দাদের নজরে এলেও বাংলাদেশে এ নিয়ে কখনো প্রকাশ্যে আলোচনা হয়নি।

বিশ্বব্যাংকের অনুসন্ধানে উঠে আসে, ‘মি. জি’ নামে পরিচিত এই ব্যক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের এই এনআইডি প্রকল্পে একটি সংঘবদ্ধ দুর্নীতির নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। ফ্রান্সের ওবেরথার কোম্পানি এবং বাংলাদেশের সাবকন্ট্রাক্টর টাইগার আইটি একসঙ্গে মিলে এ প্রকল্পে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। প্রকল্প অনুমোদন ও বাড়ানোর বদলে জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিকীর জন্য আলাদা করে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৭ লাখ ৩০ হাজার ইউরো। এরপর আরও বড় সুযোগ নিয়ে, নিরাপত্তা-হলোগ্রাম যুক্ত করার নামে চুক্তির অর্থ বাড়িয়ে সেটি দাঁড় করানো হয় প্রায় ৬১ লাখ ইউরোতে, যা বর্তমান মূল্যে ৮৮ কোটি টাকার বেশি।

টাইগার আইটির প্রধান জিয়াউর রহমান ২০১৪ সালের এপ্রিলেই ওবেরথার ও অন্য একটি কোম্পানিকে গোপনে চুক্তির শর্ত পাঠিয়ে তাদের পরামর্শ চান কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠেকানো যায়। বিশ্বব্যাংক অনুসন্ধানে প্রমাণ মেলে, এই ঘুষ লেনদেনে বড় ভূমিকা রাখেন তারেক সিদ্দিকী। এ প্রকল্পের সব নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের হলেও প্রকল্প ইউনিটে দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হাতে। সেখানেই ছিল এই ‘পিছনের দরজা’।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ওবেরথার চুক্তি পায় এবং ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে চুক্তি সই হয়। এরপর মন্ত্রিসভার অনুমোদন এনে দ্রুত প্রকল্পের পরিমাণ ৭ কোটি এনআইডি কার্ড থেকে বাড়িয়ে ৯ কোটি কার্ড করার সিদ্ধান্ত হয়। এই অনুমোদন আনতেই সরাসরি কাজ করেন জেনারেল তারেক। টাইগার আইটি ও ওবেরথার মিলে এ জন্য ‘প্রশিক্ষণ খরচ’ দেখিয়ে ৭ লাখ ৩০ হাজার ইউরো পাঠায়। এরপর আরও বড় ‘হলোগ্রাম প্রকল্পে’ ১০.৮ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ হয়, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক বরাদ্দ রাখা হয় জেনারেল তারেকের জন্য।

তারেক আহমদ সিদ্দিকীর যোগাযোগ

এক পর্যায়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে মুখোমুখি দেখা হয় ওবেরথার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ‘জি’-এর। পরে ওবেরথারের এক কর্মী স্বীকার করেন, ‘এই জি ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এবং প্রকল্পে তার প্রভাব ছিল ব্যাপক।’ মুখচেনা এই গোঁফওয়ালা ব্যক্তিটি ছিলেন জেনারেল তারেক। ফরাসি প্রসিকিউটরদের অনুসন্ধানেও প্রমাণ মেলে, সরকারি কর্মকর্তার পরিচয়ে ওই ‘জি’ আসলে তারেক আহমেদ সিদ্দিকী।

এদিকে টাইগার আইটি সব সময় দাবি করেছে তারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। অথচ অনুসন্ধানে উঠে আসে, কোম্পানিটির মালিক জিয়াউর রহমান এক সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের সাবেক স্বামীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। টাইগার আইটি ২০০৮ সালেও সেনাবাহিনী পরিচালিত একই নির্বাচন কমিশন প্রকল্পে কাজ করেছিল এবং পরবর্তীতে করোনাকালে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির সঙ্গেও কাজ করেছে।

এদিকে দুর্নীতির এমন ঘটনার মধ্যেও ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশ বাংলাদেশে নিজেদের অস্ত্র বাণিজ্যের স্বার্থে তারেকের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে। ফরাসি এয়ারফোর্স প্রধান ২০২০ সালে ঢাকায় এসে ব্যক্তিগত বৈঠক করেন তারেকের সঙ্গে। ইউরোফাইটার টাইফুন বিক্রির প্রচারণাতেও তারেককে কাছে টানতে সক্রিয় ছিল ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেছিলেন এই বিষয়ে।

আইনগতভাবে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও বিশ্বব্যাংক ঘুষ কেলেঙ্কারিতে টাইগার আইটি, ওবেরথার ও সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দিলেও বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন কখনো তদন্ত শুরু করেনি। বরং টাইগার আইটি ঢাকায় প্রভাব খাটিয়ে একটি মামলা করে ওবেরথারের পাওনা টাকা আটকে রাখে এবং সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যায়।

২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংকের নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত আসে — টাইগার আইটির ৯ বছরের জন্য, ওবেরথারের ৩ বছরের জন্য। তবে সেই সময়ে জেনারেল তারেক সিদ্দিকী ছিলেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর তিনি দেশ ছাড়েন। তখন মানবতাবিরোধী অপরাধ ও দুর্নীতির মামলায় তার নাম আসে, তবে এনআইডি দুর্নীতি মামলায় নয়।

তারেক আহমেদ সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (বামে) পাশে বসে আছেন, যখন ২০২৪ সালের ২১ জুলাই তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সামরিক ও বেসামরিক শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমনের কৌশল নিয়ে বৈঠক করেন — দেশ ছাড়ার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে।

অন্যদিকে তারেকের পরিবারও দারুণভাবে লাভবান হয়েছে। তার স্ত্রী মালয়েশিয়ায় কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি কিনেছেন, মাল্টার ‘গোল্ডেন পাসপোর্ট’ নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। লন্ডনে তার মেয়ে বুশরা সিদ্দিকী মাত্র কলেজ শেষ করে দেড় মিলিয়ন পাউন্ডের বাড়ি কেনেন। ঢাকায় তারেক সিদ্দিকীর নামে বারিধারা-গুলশানে বাড়ি, বসুন্ধরায় তিনটি প্লট, দুটি ফার্মহাউস ও শহরতলিতে ১৬ একর জমির খোঁজ মেলে। যদিও অফিসিয়াল হিসেবে এগুলোর মূল্য ৩৮ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, বাস্তবে তা আরও ২০ গুণ বেশি বলে অনুমান প্রথম আলোর।

বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে ফরাসি প্রসিকিউটররা জানিয়েছে, পুরো এই দুর্নীতির স্থপতি ছিলেন এই ‘জি’ — যার পূর্ণ পরিচয় ছিল জেনারেল তারেক সিদ্দিকী। বিদেশি সংস্থাগুলোর তদন্তে এই তথ্য উন্মোচিত হলেও বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই ঘটনা ছিল পর্দার আড়ালে।

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT