গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পূর্বঘোষিত ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বুধবার শহরের পৌর পার্ক ও লঞ্চঘাট এলাকায় সহিংসতায় উত্তাল হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। দুপুর আড়াইটার দিকে কর্মসূচির মঞ্চে কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দিতে শুরু করতেই সশস্ত্র হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, ইটপাটকেল ছোঁড়া ও ব্যাপক ভাঙচুর শুরু হয়। একপর্যায়ে সমাবেশস্থলের মঞ্চে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, চেয়ার-টেবিল রাস্তায় এনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং পুরো এলাকা কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, যান চলাচলও বন্ধ হয়ে পড়ে। এনসিপি নেতারা পরে পুলিশের নিরাপত্তায় শহর ত্যাগ করলেও তারা অভিযোগ করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা শুরুতে নিষ্ক্রিয় ছিল।
এনসিপির নেতাদের বহনকারী ১৫-১৬টি গাড়ির বহরকে শহরের বাইরে নিতে পুলিশ ও র্যাব পাহারা দিলেও হামলার তীব্রতায় তাদের আবার শহরের ভেতরে ফিরিয়ে এনে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়। পুলিশের গাড়ি, ইউএনওর গাড়ি, গণমাধ্যমের গাড়ি এবং এনসিপির গাড়িগুলো ভাঙচুর করা হয়, হামলাকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে এবং আটকে পড়া কয়েকজনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। সেনা-পুলিশের এই তৎপরতার প্রশংসা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, তবে তারা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে—এই হামলায় জড়িতদের বিচার হবে এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের ছাড় দেওয়া হবে না।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, সারজিস আলমসহ দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতা এ ঘটনায় সরাসরি আক্রান্ত হন এবং পরে তারা পুলিশের তত্ত্বাবধানে শহর ত্যাগ করেন। এনসিপির নেতা সারজিস আলম এক ফেসবুক পোস্টে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় বলে অভিযোগ করে সারা দেশের মানুষকে গোপালগঞ্জে আসার আহ্বান জানান। দলের অন্য নেতারা জানান, সমাবেশ চলাকালে এবং শেষে হামলার শিকার হন তারা। আহতের বিষয়ে এখনো নিশ্চিত না হলেও বিপুল সংখ্যক কর্মী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
এ হামলার প্রতিবাদে সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ব্লকেড কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছেন, স্থানীয় ছাত্রসংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ চলবে। গোপালগঞ্জে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জেলা প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেছে, যার ফলে এখন কোনো সভা-সমাবেশ বেআইনি হিসেবে গণ্য হবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এনসিপির কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে বলেন, “ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর দুষ্কৃতিকারীরা দেশে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে।” তিনি দাবি করেন, “এ হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ ও আগুন দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা দেশের পরিস্থিতিকে বেসামাল করে ইন্টেরিম সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির অপচেষ্টা।” তিনি দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
এই ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে এখন গোটা দেশের রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এনসিপির এই ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ সমাবেশটি ছিল তাদের ঘোষিত গণ অভ্যুত্থান আন্দোলনের বর্ষপূর্তির অংশ। অথচ এই কর্মসূচি তাদের ওপর বর্বর হামলার দৃশ্য এবং সহিংসতা দিয়ে চিহ্নিত হলো।