জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দেওয়ার প্রতিবাদে এনবিআরের কর্মকর্তারা গতকাল (২১ মে) থেকে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ শুরু করেছেন এবং আগামী রবিবার (২৫ মে) থেকে দেশব্যাপী পূর্ণদিবস ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছেন। তারা এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের অপসারণসহ বেশ কিছু দাবির কথা জানিয়েছেন।
এক সংবাদ সম্মেলনে ‘এনবিআর রিফর্ম ইউনিটি পরিষদ’ নামের প্ল্যাটফর্মের নেতারা জানান, রবিবার থেকে সব আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট অফিসে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালন করা হবে, তবে কাস্টমস হাউস ও স্থল শুল্ক স্টেশনগুলো এ কর্মসূচির বাইরে থাকবে। তাদের দাবি পূরণ না হলে ২৬ মে থেকে আন্তর্জাতিক যাত্রী সেবা বাদে এনবিআরের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে এনবিআরের কর্মকর্তারা প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টার কলমবিরতি পালন করে আসছেন। একই সঙ্গে তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে দাবি-দাওয়ার একটি স্মারকলিপি পেশ করার ঘোষণা দেন। প্রতিবাদকারীরা জানান, অর্থ উপদেষ্টা, এনবিআর কর্মকর্তাদের এবং রাজস্ব সংস্কার কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত একটি বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে। তারা এই বৈঠককে হতাশাজনক বলেছেন। নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদরা এ আন্দোলনের কারণে আমদানি-রপ্তানি, সরকারি রাজস্ব আয় ও ভবিষ্যৎ বিনিয়োগে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “পূর্ণ ধর্মঘট হলে রাজস্ব সংগ্রহে বড় ধাক্কা লাগবে। রপ্তানি বিলম্বিত হলে রপ্তানিকারকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমদানি বন্ধ হলে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়বে, যার প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে পড়বে।” তিনি আরও বলেন, “এতে করে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে, এনবিআরের অন্যান্য সংস্কার কার্যক্রম থমকে যাবে এবং জাতীয় বাজেট বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।” তৌফিকুল ইসলাম সকল পক্ষের প্রতি খোলামেলা ও স্বচ্ছ আলোচনার আহ্বান জানান, কারণ অতীতে স্বচ্ছতার অভাবে নীতিগত উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “পূর্ণ ধর্মঘট হলে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম থেমে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আসন্ন ঈদের আগে বেতন-বোনাস দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা অনেক আগে থেকেই এনবিআরকে পৃথক করার পক্ষে ছিলাম, তবে নতুন দুই বিভাগের নেতৃত্ব যেন এনবিআর থেকে নেওয়া হয়, সেটাই হওয়া উচিত।”
গত ১২ মে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআর ভেঙে দুটি নতুন বিভাগে ভাগ করা হয় – রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা। এনবিআর কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, এ অধ্যাদেশটি গোপনে এবং তড়িঘড়ি করে পাস করা হয়েছে এবং রাজস্ব সংস্কার কমিটির সুপারিশকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ, গোপনে পাস করা অধ্যাদেশ বাতিল, রাজস্ব সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ এবং সকল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে রাজস্ব ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করতে তারা দাবি জানান।
মঙ্গলবারের বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমি বেশি সময় দেব না, ৬–৭ মিনিটের বেশি নয়।” এই মন্তব্যে উপস্থিত কর্মকর্তারা হতবাক হন। এক পর্যায়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আমি যখন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ছিলাম, তখন আমাদের সচিবের কক্ষে ঢুকতে দেওয়া হতো না।” তিনি আরও বলেন, “আপনারা বার অ্যাসোসিয়েশন, টিআইবি, সিপিডিকে যুক্ত করছেন, রিট করছেন – আমি এসবের তোয়াক্কা করি না।” একজন কর্মকর্তা কথা বলার চেষ্টা করলে, উপদেষ্টা তাঁকে থামিয়ে দেন।
পরে অর্থ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “অধ্যাদেশ সংক্রান্ত উদ্বেগ, মতামত ও পরামর্শ গুরুত্বসহকারে শোনা হয়েছে এবং সেগুলো বিবেচনা করা হবে।” অপরদিকে, আন্দোলনরত কর্মকর্তারা ওই বৈঠককে ফলপ্রসূ নয় বলে অভিহিত করে ‘পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন ও কর্মবিরতি’ ঘোষণার কথা জানান।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৫৩% আদায় হয়েছে। এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে বাকি ৪৭% সংগ্রহ করতে হবে। তবে এনবিআর কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, মে মাসে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হতে পারে।