ভোলার ভোলা সরকারি কলেজের ছাত্রদল নেত্রী ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুকর্ণা আক্তার ইস্পিতা (২১) ঢাকাগামী এমভি কর্ণফুলী-০৪ লঞ্চ থেকে ১৭ জুন সকালে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নিখোঁজ হন। চার দিন নিখোঁজ থাকার পর ২১ জুন রাতে লক্ষ্মীপুরের চর রমনী মোহন ইউনিয়নের বুড়িরঘাট এলাকার মেঘনা নদীতে তার মরদেহ পাওয়া যায়।
এই ঘটনার চার দিন আগে ১৩ জুন নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি আবেগঘন পোস্ট দিয়েছিলেন ইস্পিতা। সেখানে তিনি ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সুবিধাবাদী গ্রুপের হুমকি এবং অবমাননার কথা উল্লেখ করে লেখেন, রাজনীতি তার মতো সফট হার্টের মানুষের জন্য নয়। পোস্টে তিনি অভিযোগ করেন, রাজনীতিতে আসার পর এক সুবিধাবাদী গ্রুপ তাকে নানা ভাবে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রেখেছে। বিশেষ করে তার ছোট বোনের বয়সী ইমা শিকদার নামের এক ছাত্রী নেত্রীর আচরণে চোখে পানি এসেছে বলে উল্লেখ করেন।
পোস্টের এক পর্যায়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি রাজনীতিকে সহজভাবে দেখতাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এখানে কত জটিলতা। এসব কথা সহ্য করতে না পেরে আমার বুকে ব্যথা হচ্ছে। আমি স্বেচ্ছায় রাজনীতি ত্যাগ করলাম। যারা আমাকে হুমকি দিয়েছে তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।’
পোস্ট দেওয়ার চার দিন পরই ঢাকাগামী লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাঁপ দেন তিনি। কর্ণফুলী-০৪ লঞ্চের সুপারভাইজার জানান, ইলিশা ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার কিছু সময় পর মেহেন্দীগঞ্জের কালিগঞ্জ অতিক্রম করে তৃতীয় তলা থেকে এক তরুণী নদীতে ঝাঁপ দেন। লঞ্চ দ্রুত ঘুরিয়ে লাইফবয়া ফেলে উদ্ধার চেষ্টা করা হলেও মেয়েটি চোখের আড়াল হয়ে যান।
লঞ্চে থাকা এক নারী যাত্রী ৯৯৯-এ কল করে জানান, ওই তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। বিষয়টি জানার পর মুন্সিগঞ্জ সদর থানা-পুলিশ লঞ্চের দুই স্টাফ, রাসেল হৃদয়, কেবিন বয় শান্ত এবং শমশেরসহ অভিযোগকারী নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেয়। প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
২১ জুন রাতে মেঘনা নদীতে অজ্ঞাত তরুণীর মরদেহ ভেসে উঠলে স্থানীয়রা নৌ-পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে আইনি প্রক্রিয়া শেষে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করে। ২২ জুন বিকেলে ইস্পিতার বাবা মাসুদ রানা জামাকাপড় ও ছবি দেখে মরদেহ শনাক্ত করেন।
ইস্পিতার বাবা মাসুদ রানা
ইস্পিতার বাবা জানান, তার মেয়ে সেদিন টিউশনি পড়ানোর কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। পরে লঞ্চে উঠেছিলেন কেন, সেটা জানার জন্য মোবাইল কললিস্ট ও ট্র্যাকিং করলে সবকিছু বের হবে। তিনি অভিযোগ করেন, কেউ তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছে কিংবা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
ছাত্রদল নেত্রী ইস্পিতার মৃত্যুর ঘটনায় ছাত্রদলের একাংশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ভোলা জেলা ছাত্রদলের সদস্যসচিব ফজলুল করিম ছোটন বলেন, ইস্পিতা ছাত্রদলের সাহসী নেত্রী ছিলেন। গণ-অভ্যুত্থানেও রাজপথে লড়াই করেছিলেন। তার রহস্যজনক মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। প্রকৃত কারণ উদঘাটন এবং দায়ীদের বিচারের দাবিতে মঙ্গলবার সকাল ১১টায় ভোলায় প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ বলছে, বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ভোলা সদর মডেল থানার ওসি হাসনাইন আহমেদ পারভেজ জানান, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনে কাজ চলছে। এ ঘটনায় লক্ষ্মীপুর সদর থানায় একটি হত্যা মামলা রুজু করা হয়েছে।
ইস্পিতার মৃত্যু এখন ভোলার ছাত্র রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে। চার দিন আগের সেই ফেসবুক পোস্ট এবং লঞ্চের রহস্যজনক ঘটনা নতুন করে প্রশ্ন তুলছে, এটি আত্মহত্যা না কি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড? তদন্তের দাবি দিন দিন জোরালো হচ্ছে।