নিজভূমে পরবাসী —নন্দা নগরের শেষ মুসলিম আহমদ হাসান - দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ
নোটিশ:

নিজভূমে পরবাসী —নন্দা নগরের শেষ মুসলিম আহমদ হাসান

রাউফুর রহমান
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫
  • ১৪৯ বার দেখা হয়েছে
ভারতে মুসলিম নির্যাতন,উত্তরাখণ্ড মুসলিম বিতাড়ন

নিজভূমে পরবাসী—নন্দা নগরের শেষ মুসলিম আহমদ হাসান বলেন, “তবুও আমি ছেড়ে যাইনি।”

নন্দা নগরের শেষ মুসলিম পুরুষের একাকী লড়াই

এক হিন্দু নারীর যৌন হয়রানির অভিযোগকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়ে মুসলিমবিরোধী সহিংসতা। পালিয়ে যায় শহরের সব মুসলিম পরিবার। থেকে যান শুধু আহমদ হাসান। পরিবারের সঙ্গে এখন একাকী, আতঙ্কে দিন কাটে তার। শহরের শেষ মুসলিম পুরুষ তিনি।

ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের নন্দা নগরের বাসিন্দা ৪৯ বছর বয়সী আহমদ হাসান প্রতিদিন সকাল ৮টায় নন্দাকিনী নদীর তীরে তার ড্রাই-ক্লিনিং-এর দোকান খুলে বসেন। দোকানের গোলাপি দেয়ালে প্লাস্টিকে মোড়ানো জামা-কাপড় ঝুলিয়ে রেখে তিনি অপেক্ষা করেন গ্রাহকদের।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দুপুরের মধ্যেই আসতেন ২০ থেকে ২৫ জন গ্রাহক। কেউ আনতেন শেরওয়ানি, কেউ স্যুট, কেউ আবার শীতের কোট বা প্যান্ট। চা খেতে খেতে হাসানের সঙ্গে চলত রাজনীতি, হাসি-ঠাট্টা। অধিকাংশই হিন্দু, অল্প কিছু মুসলিম।

কিন্তু এখন? প্রতিদিন গড়ে পাঁচজনেরও কম হিন্দু গ্রাহক আসেন। মুসলিম তো নেই-ই। কারণ, শহরে এখন আর কোনো মুসলিমই নেই—সবার শেষ আশ্রয় হিসেবে রয়ে গেছেন কেবল আহমদ হাসান।

নন্দা নগরে বহু প্রজন্ম ধরে বসবাস করে আসছিল ১৫টি মুসলিম পরিবার। এখানেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা হাসানের। হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে ছিল আত্মিক সম্পর্ক—উৎসবে নিমন্ত্রণ, ঈদে আপ্যায়ন, এমনকি হিন্দু বন্ধুদের শেষকৃত্যে সহায়তা করতেন হাসান।

তবে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি বদলে যায়। এক হিন্দু ছাত্রী স্থানীয় মুসলিম নাপিত মোহাম্মদ আরিফের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন। এরপরই শুরু হয় চরম উত্তেজনা। যদিও কোভিড-১৯–এর সময় থেকেই সংখ্যালঘুদের প্রতি মানুষের মনোভাব বদলে যেতে দেখছিলেন হাসান। তখন থেকেই ‘করোনা জিহাদ’ নামে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ানো হয়—যেন মুসলিমরাই ইচ্ছাকৃতভাবে ভাইরাস ছড়াচ্ছে।

ঘটনার পর ১ সেপ্টেম্বর দোকানদার সমিতির ডাকে এক সমাবেশ হয়, যেখানে মুসলিমরাও অংশ নেন। হাসান বলেন, ‘আমরা না গেলে হিন্দুরা বলত, আমরা অপরাধ সমর্থন করছি।’

কিন্তু সমাবেশেই শুরু হয় স্লোগান—‘মুল্লোঁ কে দালালোঁ কো… জুতে মারো সালো কো।’ এরপর মুসলিম যুবক হারুন আনসারিকে মারধর করা হয়। অভিযোগ ওঠে, মুসলিমরাই অভিযুক্ত আরিফকে পালাতে সাহায্য করেছে।

শুরু হয় সহিংসতা। ইট-পাথর ছুড়ে বাড়িঘর, দোকান ভাঙচুর হয়। হাসানের দোকানও রেহাই পায়নি—শাটার ভাঙা, কাপড় ছড়িয়ে, কাউন্টারের ৪ লাখ রুপি গায়েব। দোকানের সাইনবোর্ড ‘দ্য হাসান ড্রাইক্লিনার্স’ নদীর তীরে পড়ে ছিল টুকরো টুকরো হয়ে।

২ সেপ্টেম্বর আবারও হয় বড় বিক্ষোভ, যেখানে বক্তৃতা দেন উগ্রপন্থী দর্শন ভারতী। তারপরেই শুরু হয় বড় আকারের সহিংসতা—মুসলিমদের বাড়ি, অস্থায়ী মসজিদ, গাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ ছিল অসহায়। শহরের একমাত্র বহুতল ভবনে আশ্রয় নেন সব মুসলিম পরিবার।

অভিযুক্ত আরিফ ২ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হলেও, এরপর পুলিশ মুসলিমদের জানিয়ে দেয়, তারা আর নিরাপত্তা দিতে পারবে না। রাতে গাড়িতে করে পার্শ্ববর্তী শহরে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় পুলিশ। শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় বাকি মুসলিম পরিবারগুলো।

হাসান ও তার পরিবার চলে যান ২৬৬ কিলোমিটার দূরে দেরাদুন। ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি ও মোহাম্মদ আয়ুম হাইকোর্টে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেন। আদালত নির্দেশ দেয় আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে।

হাসানের স্ত্রী ছিলেন সবচেয়ে সাহসী—সন্তানদের নিয়ে প্রথম ফিরে আসেন শহরে। ১৬ অক্টোবর হাসান ফিরে এসে দেখেন, দোকানের বিপরীতে এক হিন্দু ব্যক্তি খুলে বসেছেন ড্রাই-ক্লিনিং দোকান।

হিন্দুদের মধ্যে তখন অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা—মুসলিমদের কেউ সাহায্য করবে না। হাসান বলেন, ‘সেই দিন আমি বুঝলাম, ড্রাই-ক্লিনিংয়েরও একটা ধর্ম আছে।’

ঘৃণার একঘরে জীবন

এখনও তার দোকানে আগের গ্রাহকরা ফিরেননি। ফোনেও কথা বলেন না। তার ১৬ বছর বয়সী মেয়েকেও স্কুলে বলা হয়েছিল, ‘তাকে বের করে দেওয়া উচিত, কারণ সে মুসলিম।’ পরে প্রিন্সিপাল হস্তক্ষেপ করলে হয়রানি বন্ধ হয়।

ওসি সঞ্জয় সিং নেগি নিজের চোখে দেখা হামলার বিবরণ দিয়ে এফআইআর করলেও এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি। পুলিশ এ বিষয়ে মুখ খুলছে না।

নন্দা নগরের ঘটনাটি একক নয়—রাজ্যের বহু শহরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে চলছে একই ধরনের বয়কট, নিপীড়ন, উচ্ছেদ। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নিরাপত্তাহীনতায় কাঁপছে সাধারণ মুসলিমরা।

তবু হাসান নড়েননি। তার ভাষায়, ‘এই শহরই আমার একমাত্র বাড়ি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই থাকব।’
কিন্তু সেই থাকার গল্পটা এখন শুধুই নিঃসঙ্গতা, একঘরে হয়ে বেঁচে থাকা—নিজভূমে পরবাসীর মতো।

তথ্যসূত্রঃ আল জাজিরা
ছবি: কাল্পনিক

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT