যেভাবে জর্জ সরোস ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধ্বসিয়ে দেন - দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ
নোটিশ:
শিরোনামঃ
জাবিতে প্রাণ রসায়ন বিভাগের নবীন শিক্ষার্থীদের র‍্যাগিং বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারিয়ার ক্লাবের নতুন কমিটি ঘোষণা বিদেশে নতুন আগত বাংলাদেশিদের প্রতি অমানবিক আচরণ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন ফজলে এলাহী সাবেক সেনাকর্মকর্তার জবানিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর প্রকৃত চিত্র কাতার–সৌদি মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত ‘আপাতত স্থগিত’ করল আফগানিস্তান পাকিস্তান আবারও আফগান সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করলে আফগান বাহিনী জবাব দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত বালিয়াকান্দিতে টাইফয়েড প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সের ক্লাস করতে এসে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা আটক কুবির তিন শিক্ষার্থী নোবিপ্রবি মডেল ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্সে পুরস্কার জয়ী রাজবাড়ীর কালুখালীর গুণী সংগীতশিল্পী জাহিদ হাসানের মৃত্যু

যেভাবে জর্জ সরোস ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধ্বসিয়ে দেন

অর্থনীতি ডেস্ক
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • ১১৩ বার দেখা হয়েছে

১৯৯২ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর, যা ইতিহাসের পাতায় ‘ব্ল্যাক ওয়েডনেসডে’ (Black Wednesday) নামে পরিচিত, বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। এই দিনে হেজ ফান্ড ব্যবস্থাপক জর্জ সরোস তার কৌশল ও আর্থিক অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাজি ধরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের মুনাফা অর্জন করেন। এই ঘটনাটি শুধু সরোসের ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়, বরং এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সীমাবদ্ধতা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং ফটকাবাজারের (speculative market) অমিত ক্ষমতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

প্রেক্ষাপট: ইউরোপীয়ান এক্সচেঞ্জ রেট মেকানিজম (ERM)

ব্ল্যাক ওয়েডনেসডে-র ঘটনাটি বোঝার জন্য ইউরোপীয়ান এক্সচেঞ্জ রেট মেকানিজম (ERM) সম্পর্কে জানা জরুরি। ১৯৮০-এর দশকে ইউরোপের দেশগুলো তাদের মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যার নাম ERM। এর মূল লক্ষ্য ছিল সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং একক ইউরোপীয় মুদ্রা চালুর ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এই ব্যবস্থায়, প্রতিটি সদস্য দেশের মুদ্রার একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় বিনিময় হার (central parity rate) নির্ধারণ করা হয় এবং সেটির একটি নির্দিষ্ট সীমার (সাধারণত ±২.২৫%) মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেওয়া হয়। কোনো দেশের মুদ্রা এই সীমার বাইরে চলে গেলে, সেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হস্তক্ষেপ করে মুদ্রার মান সেই সীমার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হতো।

১৯৯০ সালে ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিংও (GBP) এই ব্যবস্থায় যোগ দেয়। তবে, প্রথম থেকেই ব্রিটিশ অর্থনীতির মৌলিক কাঠামোতে কিছু সমস্যা ছিল। বিশেষ করে, যুক্তরাজ্যের সুদের হার এবং জার্মানির সুদের হারের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য ছিল। জার্মানি তাদের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে উচ্চ সুদের হার বজায় রেখেছিল, কিন্তু যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি তখন মন্দার কবলে ছিল, যেখানে উচ্চ সুদের হার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বাধা দিচ্ছিল। এর ফলে, পাউন্ডের বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে বেশি মনে হচ্ছিল, যা বাজার বিশ্লেষকদের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

জর্জ সরোসের কৌশল: “শর্টিং” এর মাস্টারক্লাস

জর্জ সরোস এবং তার কোয়ান্টাম ফান্ড এই অর্থনৈতিক দুর্বলতাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তারা বুঝতে পারছিলেন যে পাউন্ডের বিনিময় হার ধরে রাখা ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের জন্য টেকসই হবে না। পাউন্ডের মূল্য কৃত্রিমভাবে অতিরিক্ত ধরা হয়েছে এবং এটি তার প্রকৃত অর্থনৈতিক মূল্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এই অনুমানের ভিত্তিতে, সরোস পাউন্ডের বিরুদ্ধে একটি বিশাল আর্থিক ঝুঁকি নিলেন, যা ‘শর্ট সেলিং’ নামে পরিচিত।

শর্ট সেলিংয়ের প্রক্রিয়া:

সাধারণভাবে, শর্ট সেলিংয়ের মাধ্যমে একজন বিনিয়োগকারী এমন একটি সম্পদ বিক্রি করেন যা তার কাছে নেই, এই প্রত্যাশায় যে ভবিষ্যতে এর দাম কমবে। এরপর তিনি কম দামে সেই সম্পদ কিনে তা ফেরত দেন এবং মাঝের পার্থক্য থেকে লাভ করেন। সরোসের ক্ষেত্রে, প্রক্রিয়াটি ছিল নিম্নরূপ:

১. বৃহৎ ঋণ গ্রহণ: সরোস তার তহবিলের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ব্রিটিশ পাউন্ড ধার করেন। এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ বিলিয়ন পাউন্ড, যা তৎকালীন সময়ে একটি অবিশ্বাস্য অঙ্ক।

২. মুদ্রা বিনিময়: ধার করা পাউন্ডগুলো তিনি তৎক্ষণাৎ জার্মান মার্ক এবং অন্যান্য শক্তিশালী মুদ্রায় রূপান্তর করেন। এর ফলে বাজারে পাউন্ডের সরবরাহ এক ধাক্কায় অনেক বেড়ে যায়, যার কারণে এর বিনিময় হারে চাপ তৈরি হয়।

৩. বাজারের ওপর চাপ: সরোসের এই বিশাল পরিমাণ বিক্রির ফলে বাজারে একটি প্যানিক সৃষ্টি হয়। অন্যান্য ফটকাবাজ এবং বিনিয়োগকারীরাও পাউন্ডের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং তারাও পাউন্ড বিক্রি করা শুরু করে। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার জন্ম দেয়, যেখানে পাউন্ডের ওপর বিক্রির চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে।

ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের ব্যর্থ প্রতিরোধ

পাউন্ডের ওপর এই অস্বাভাবিক চাপ দেখে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড বসে থাকেনি। ERM-এর নিয়ম অনুযায়ী, তাদের পাউন্ডের বিনিময় হার নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ধরে রাখতে হতো। তাই তারা কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে:

১. মুদ্রা কেনা: ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড খোলা বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ পাউন্ড কিনতে শুরু করে, যাতে এর মূল্য বৃদ্ধি পায়। এই প্রক্রিয়াতে তাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহার করতে হয়।

২. সুদের হার বৃদ্ধি: মুদ্রার মান ধরে রাখতে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড একদিনের মধ্যেই সুদের হার দুইবার বাড়ায়। প্রথমে এটি ১০% থেকে ১২%-এ এবং পরে ১৪%-এ উন্নীত করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ব্রিটিশ সম্পদ কেনার জন্য উৎসাহিত করা, যা পাউন্ডের চাহিদা বাড়াত।

তবে, এই সব পদক্ষেপ সত্ত্বেও, সরোস এবং অন্যান্য ফটকাবাজদের সম্মিলিত চাপ ছিল অনেক বেশি। সুদের হার বৃদ্ধি সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীরা পাউন্ডের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিত ছিল না। অন্যদিকে, ব্রিটিশ সরকারও উচ্চ সুদের হার অনির্দিষ্টকালের জন্য ধরে রাখতে পারত না, কারণ এটি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিত।

“ব্ল্যাক ওয়েডনেসডে” এবং ফলশ্রুতি

অবশেষে, ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯২ সালে, ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে যে তাদের পক্ষে পাউন্ডের বিনিময় হার ধরে রাখা অসম্ভব। সেদিন সন্ধ্যায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী নর্ম্যান ল্যামন্ট ঘোষণা করেন যে যুক্তরাজ্য ERM থেকে তাদের সদস্যপদ প্রত্যাহার করছে। এর ফলে পাউন্ডের বিনিময় হার উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং এর মূল্য প্রায় ১৫% কমে যায়।

এই নাটকীয় পতনের ফলস্বরূপ, জর্জ সরোস বিশাল মুনাফা অর্জন করেন। তিনি যে পাউন্ডগুলো বিক্রি করেছিলেন, সেগুলোর মূল্য কমে যাওয়ায় তিনি কম দামে সেগুলো বাজার থেকে কিনে তার ধার শোধ করতে সক্ষম হন। এই প্রক্রিয়ায় তার আনুমানিক মুনাফা ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ এবং শিক্ষা

ব্ল্যাক ওয়েডনেসডে-র ঘটনাটি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শিক্ষা দেয়:

১. বাজারের শক্তি: এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, ফটকাবাজরা সম্মিলিতভাবে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হতে পারে, যদি সেই দেশের অর্থনীতির মৌলিক কাঠামোতে দুর্বলতা থাকে।

২. মুদ্রা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা: ERM-এর মতো নির্দিষ্ট বিনিময় হারের ব্যবস্থাগুলো সবসময় কার্যকর হয় না, বিশেষ করে যদি সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক নীতিতে বড় ধরনের অসঙ্গতি থাকে।

৩. স্বচ্ছতার অভাব: এই ঘটনা থেকে একটি প্রশ্ন উঠেছে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কতটা স্বচ্ছ হওয়া উচিত। সরোসের কৌশল ছিল বাজারের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করা, যা ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের হস্তক্ষেপের ব্যর্থতাকে উন্মোচন করেছিল।

জর্জ সরোসের ১ বিলিয়ন ডলারের মুনাফা শুধু একটি ব্যক্তিগত সাফল্য ছিল না, বরং এটি আধুনিক আর্থিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি দেখিয়েছে যে, একজন অভিজ্ঞ আর্থিক বিশ্লেষক কীভাবে অর্থনীতির মৌলিক নীতিগুলো ব্যবহার করে বাজারে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারেন। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আর্থিক বাজারগুলো সব সময় যুক্তিসঙ্গত হয় না, এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকে সেইসব বিনিয়োগকারীরা যারা বাজারের ভুল অনুমানগুলো ধরতে পারে।

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT