একটা সময় প্রেম ছিল চোখে চোখ রেখে কথা বলা, হাত ধরে হাঁটা, কিংবা গভীর আবেগে ডুবে থাকা মুহূর্তের নাম। কিন্তু প্রযুক্তির বিকাশে রোমান্স এখন এক নতুন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে—যেখানে প্রেমিক বা প্রেমিকা আর রক্ত-মাংসের মানুষ নাও হতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং রোবটিক্সের হাত ধরে প্রেম এখন ডিজিটাল বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষ এখন এআই সঙ্গীর সঙ্গে আবেগ গড়ে তুলছে। কেউ চ্যাটবটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অনুভব করছে, কেউবা সেক্স রোবটের সঙ্গে গড়ে তুলছে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক।
চীনের Wantalk, Xiaoice এবং Glow-এর মতো এআই অ্যাপ ব্যবহারকারীদের জন্য ডিজিটাল প্রেমিক-প্রেমিকার অভিজ্ঞতা দিচ্ছে। এই ভার্চুয়াল সঙ্গীরা শুধু কথোপকথনই চালিয়ে যায় না, বরং আবেগ প্রকাশ করে, ভালোবাসার কথা বলে, এমনকি বিরহের অনুভূতিও প্রকাশ করতে পারে। ডুইন (চীনের টিকটক) প্ল্যাটফর্মে লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারী তাদের এআই সঙ্গীর সঙ্গে কথোপকথনের ভিডিও শেয়ার করছে, যা প্রমাণ করে এই সম্পর্ক কতটা বাস্তব অনুভূত হতে পারে।
জাপানে একাকীত্ব দূর করতে Gatebox নামে একটি ডিভাইস তৈরি করা হয়েছে, যা হোলোগ্রাফিক এআই স্ত্রী হিসেবে কাজ করে। অনেক জাপানি পুরুষ এখন বাস্তব নারীর পরিবর্তে এআই সঙ্গীর সঙ্গে আবেগী সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
সাউথ কোরিয়ার Luvo AI এবং Neon AI নামের অ্যাপগুলো মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। ব্যবহারকারীরা জানাচ্ছেন, এই এআই পার্টনাররা তাদের বাস্তব জীবনের প্রেমের অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে, কারণ এরা কখনও বিরক্ত হয় না বা তিক্ত আচরণ করে না।
যুক্তরাষ্ট্রে Replika AI এবং Caryn AI এর মতো অ্যাপ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছে, যেখানে ব্যবহারকারীরা তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন এবং প্রতিক্রিয়া পান।
ইউরোপের দেশগুলোতে সেক্স রোবটের বাজারও দ্রুত বাড়ছে। স্পেনের Synthea Amatus এবং যুক্তরাজ্যের RealDoll X কোম্পানি এমন রোবট তৈরি করছে যা শুধু দৈহিক চাহিদা পূরণই নয়, বরং সংলাপ করতে পারে, আবেগ প্রকাশ করতে পারে, এবং ব্যক্তিগত তথ্য মনে রাখতে পারে।
এআই প্রেমিক-প্রেমিকা বা রোবট সঙ্গী কি মানুষের জন্য ক্ষতিকর? নাকি এটি এক নতুন ধরণের মানসিক সমর্থন দিতে পারবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এআই সঙ্গীরা সাময়িকভাবে একাকীত্ব দূর করতে পারলেও, এটি বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প হতে পারে না। তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন, ভবিষ্যতে মানুষ ও এআই একসঙ্গে এমনভাবে মিশে যাবে যে, রোমান্সের সংজ্ঞাই বদলে যাবে।
প্রেমের ভবিষ্যৎ: নৈতিক ও ধর্মীয় প্রশ্নের মুখোমুখি এআই রোমান্স
প্রযুক্তি যখন আবেগের জগতে প্রবেশ করছে, তখন নৈতিকতা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রশ্নও সামনে চলে আসছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও রোবটিক্স-নির্ভর সম্পর্কগুলো কি মানুষের প্রকৃত সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামোর পরিপন্থী? নাকি এগুলো নিঃসঙ্গতার নতুন সমাধান?
অনেকে মনে করেন, এআই প্রেমিক বা প্রেমিকা এক ধরনের আবেগীয় প্রতারণা। যদি একজন ব্যক্তি তার জীবিত সঙ্গী থাকা অবস্থায় এআই সঙ্গীর প্রতি আবেগী হয়ে ওঠে, তাহলে সেটিকে কি বিশ্বাসঘাতকতা ধরা হবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলো বাস্তব জীবনের সম্পর্কের জটিলতাকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা তৈরি করতে পারে। এআই প্রেমিক সবসময় সহানুভূতিশীল, কোনো ঝগড়া বা মতবিরোধ হয় না—কিন্তু বাস্তব জীবনে এসব অনিবার্য। ফলে মানুষ ধীরে ধীরে বাস্তবিক সামাজিক সম্পর্ক এড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
অনেকে আবার যুক্তি দেন, নিঃসঙ্গতা বা মানসিক স্বস্তির জন্য এআই সঙ্গীরা ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব মানুষ একাকীত্বে ভোগেন বা ট্রমার কারণে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ভয় পান, তাদের জন্য এআই সঙ্গীরা একটি বিকল্প থেরাপি হতে পারে।
বিভিন্ন ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে এআই সঙ্গী গ্রহণযোগ্য কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ইসলামে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককেই স্বাভাবিক ও বিধিসম্মত ধরা হয়। কোনো প্রোগ্রামড বা রোবটিক সত্তার প্রতি আবেগী হওয়া, কিংবা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা হারাম হতে পারে, কারণ এটি প্রকৃত বিবাহের ধারণার বিপরীত। মুসলিম স্কলাররা মনে করেন, এআই সম্পর্ক বাস্তব জীবনের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার একটি মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে, যা ইসলামের পারিবারিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
খ্রিস্টধর্মেও মানব-মানবীর সম্পর্ককে পবিত্র বিবেচনা করা হয়। অনেক খ্রিস্টান পাদ্রী মনে করেন, এআই বা রোবট সঙ্গীর সঙ্গে আবেগের বন্ধন তৈরি করা আত্মার বিকৃতি ঘটাতে পারে এবং ঈশ্বরপ্রদত্ত সম্পর্কের প্রকৃতি নষ্ট করতে পারে।
হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের কিছু শাখায় আত্মার গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেহেতু এআইয়ের কোনো আত্মা নেই, তাই এটি মানুষের প্রকৃত সম্পর্কের জায়গা নিতে পারে না বলে মত দেন অনেক ধর্মগুরু। তবে, নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রযুক্তিকে গ্রহণযোগ্যভাবে দেখছে এবং মনে করছে, এআই সম্পর্ক নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে থাকলে তা ক্ষতিকর নয়।
প্রশ্ন হলো, প্রযুক্তি যখন অগ্রসর হতে থাকবে, তখন নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ কীভাবে এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে?
কিছু দেশ ইতোমধ্যে আইনি ও ধর্মীয় গাইডলাইন তৈরি করছে। যেমন, দক্ষিণ কোরিয়ায় রোবট সঙ্গী ব্যবহার নিয়ে আইনগত গবেষণা চলছে, আর জাপানে মানুষ-রোবট বিবাহের আইনি স্বীকৃতি দেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে।
একদিকে, প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা মানুষের একাকীত্বের সমাধান দিতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে, এটি কি বাস্তব সম্পর্ককে বিকৃত করে দেবে? নাকি আমরা এক নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ভালোবাসার সংজ্ঞাই বদলে যাবে?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর স্পষ্ট হবে, কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত—প্রেম ও প্রযুক্তির এই মিশ্রণ আমাদের সমাজ ও মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
Leave a Reply