আমেরিকা বিশ্বের কাছে এক বিশেষ প্রতীক। এটি মানবাধিকার, গণতন্ত্র, আধুনিক সভ্যতা এবং উন্নয়নের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের যেখানেই নারী অধিকার লঙ্ঘিত হয়, যেখানেই শিশুদের বিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়, সেখানেই প্রথমে যে দেশটি মানবাধিকারের প্রশ্ন তোলে, সেটি হলো আমেরিকা। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি, এই আলোর আড়ালেই রয়েছে এক অন্ধকার বাস্তবতা—শিশু বিয়ে। এখনো আমেরিকার দুই-তৃতীয়াংশ রাজ্যে বাল্যবিবাহ বৈধ। যে দেশ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ বা আফ্রিকার নানা রাষ্ট্রে শিশু বিয়ে নিয়ে কড়া সমালোচনা করে, সেই দেশের ভেতরেই আজও শিশু কন্যাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের কাছে।
২০১৮ সাল পর্যন্ত আমেরিকার সবগুলো রাজ্যেই শিশু বিয়ে বৈধ ছিল। প্রথম ডেলাওয়ার রাজ্য আইন পরিবর্তন করে এই প্রথা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে। এরপর নিউ জার্সি, মিনেসোটা ও রোড আইল্যান্ডসহ আরও কিছু রাজ্য ধীরে ধীরে একই পথ অনুসরণ করে। কিন্তু এখনও ৩৪টি রাজ্যে অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ে সম্ভব। মাত্র ১৬টি রাজ্যে বাল্যবিবাহকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আরও ভয়াবহ তথ্য হলো, কিছু রাজ্যে এতদিন পর্যন্ত কোনো বয়সসীমাই নির্ধারণ করা ছিল না। নিউ হ্যাম্পশায়ারে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মেয়েদের ১৩ এবং ছেলেদের ১৪ বছরে বিয়ে বৈধ ছিল। আলাস্কা, লুইসিয়ানা ও সাউথ ক্যারোলিনায় ১২ বছরেরও কম বয়সে বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ম্যাসাচুসেটসেও ২০২২ সাল পর্যন্ত মেয়েদের ন্যূনতম বয়স ছিল ১২ বছর এবং ছেলেদের ১৪। একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতায় এই আইনগুলো কেবল বিস্ময়করই নয়, বরং ভয়াবহ।
বেসরকারি সংস্থা Unchained at Last তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে যে ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আড়াই লক্ষেরও বেশি শিশু বিয়ে করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাত্র ১০ বছরেরও নিচে ছিল। ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ৬৭ শতাংশ শিশুর বয়স ছিল ১৭, ২৯ শতাংশের বয়স ছিল ১৬, ৪ শতাংশের বয়স ছিল ১৫ এবং ১ শতাংশেরও কম ছিল ১৪ বা তার কম। এই পরিসংখ্যানের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, বিবাহিত নাবালকদের ৯০ শতাংশই ছিল মেয়ে, আর UNICEF-এর তথ্য অনুসারে ৮৬ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বিয়ে হয়েছে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সঙ্গে। প্রতিটি সংখ্যাই এখানে একেকটি ছিন্নভিন্ন শৈশব, একেকটি ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন।
এমন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারের অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বমঞ্চে যে দেশ মানবাধিকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা বলে, সেই দেশের ভেতরেই এত বড় বৈপরীত্য কীভাবে সম্ভব? আফগানিস্তানকে প্রায়ই শিশু বিয়ে ইস্যুতে সমালোচনা করা হয়। অথচ ২০১৭ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে ন্যূনতম বিয়ের বয়স ছিল ১৬ বছর, আর যুক্তরাষ্ট্রের ২৫টি রাজ্যে তখনও কোনো বয়সসীমাই ছিল না। Human Rights Watch খোলাখুলিই মন্তব্য করেছিল যে শিশু বিয়ের ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের আইন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় কঠোর। মানবাধিকারের প্রশ্নে এই ভণ্ডামি আমেরিকার নৈতিক নেতৃত্বকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
শিশু বয়সে বিয়ে মানে তাদের স্বাভাবিক শৈশব কেড়ে নেওয়া। এটি কেবল একটি আইনি ইস্যু নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকটের জন্ম দেয়। বিয়ে হয়ে গেলে বেশিরভাগ শিশু স্কুল ছাড়ে, ফলে তাদের পড়াশোনা অসমাপ্ত থেকে যায়। চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতার সুযোগ তারা হারায় এবং দারিদ্র্যচক্রে আটকে পড়ে। অল্প বয়সে গর্ভধারণ করলে জটিলতা দেখা দেয়, বাড়ে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি। প্রাপ্তবয়স্ক দায়িত্ব ও গার্হস্থ্য সহিংসতার কারণে অনেকেই বিষণ্নতা, ট্রমা কিংবা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে পড়ে। শিশু বিয়ে আসলে শুধু একটি ব্যক্তির জীবন নষ্ট করে না, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সমাজে বৈষম্য, দারিদ্র্য ও নির্যাতনের চক্রকে টিকিয়ে রাখে।
শিশু বিয়ের এই সংকট কেন বিশ্বকে উদ্বিগ্ন করছে, তার উত্তর স্পষ্ট। আমেরিকার মতো একটি দেশ যখন শিশু বিয়ে বৈধ রাখে, তখন মানবাধিকারের নৈতিক নেতৃত্ব তাদের হাতছাড়া হয়। আমেরিকার আইন, সংস্কৃতি এবং নীতি অনেক সময় অন্যান্য দেশে মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশু বিয়ে রোধে যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠছে, সেটিও দুর্বল হয়ে যায়। নারী অধিকার আন্দোলন বড় আঘাত পায়, কারণ বিশ্বব্যাপী নারী ক্ষমতায়নের লড়াইয়ের শীর্ষ সমর্থক রাষ্ট্রই যখন ভেতরে শিশু কন্যাদের হাতে তুলে দেয়, তখন বার্তাটি স্পষ্টতই দ্ব্যর্থক হয়। এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন UNICEF বা জাতিসংঘের প্রচেষ্টাও দুর্বল হয়ে পড়ে, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথার বৈধতা বিশ্বকে ভুল বার্তা পাঠায়।
তাহলে পরিবর্তন এত ধীরে আসছে কেন? এর পেছনে প্রধান কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ও স্টেট আইনের পার্থক্য। দেশটির অনেক নীতি রাজ্যভিত্তিক হওয়ায় কেন্দ্রীয়ভাবে শিশু বিয়ে নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। আবার কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী অল্প বয়সে বিয়েকে সমর্থন করে, যা আইন প্রণয়নের পথে বাধা তৈরি করে। দরিদ্র পরিবারের অনেকেই শিশুকন্যাদের দায়মুক্তি হিসেবে বিয়ে দিয়ে দেয়। আরেকটি বড় কারণ হলো রাজনৈতিক অনাগ্রহ। শিশুদের ভোটাধিকার নেই, তাই নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাদের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
অতএব, আমেরিকার শিশু বিয়ে আসলে একটি নীরব মহামারি। এটি শুধু আমেরিকার অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্যই লজ্জাজনক। বাংলাদেশ, ভারত বা আফ্রিকার বহু দেশ আজ শিশু বিয়ে রোধে আইন কঠোর করছে। অথচ উন্নত রাষ্ট্র আমেরিকা এখনো এই সংকট থেকে বের হতে পারেনি। শিশুদের অধিকার রক্ষায় আমেরিকাকে প্রথমেই নিজের ভেতরের বৈপরীত্য মেটাতে হবে। কারণ, শৈশব কেড়ে নেওয়া মানে কেবল একটি জীবনের ভবিষ্যৎ নয়, বরং মানবসভ্যতারই ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা।