বিশ্ব যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত, তখন ঘরের দুয়ারেই গোপনে তৈরি হচ্ছে এক সম্ভাব্য বিস্ফোরক অচলাবস্থা। ভারত বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্য পরিবহনের জন্য তৃতীয় দেশে কার্গো ট্রানজিট সুবিধা বাতিল করার পর বাংলাদেশ প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ভারতীয় পণ্যের ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছে সুতা, গুঁড়া দুধ, সিরামিক সামগ্রী ও টেলিভিশনের যন্ত্রাংশসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পণ্য।
এই সিদ্ধান্তের প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। বিশেষ করে, সুতা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের একটি মূল উপাদান, যা দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশ জোগান দেয় এবং লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে। শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই ভারত বাংলাদেশে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল। নতুন এই অচলাবস্থা সেই বাণিজ্যিক ভারসাম্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে এবং উৎস ও বাণিজ্যিক মিত্রদের নতুনভাবে সাজানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
এদিকে পেঁয়াজ, চিনি ও চালের মতো নিষিদ্ধ পণ্যের চোরাচালান ব্যাপকভাবে বেড়েছে। প্রতি বছর ২০ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি পণ্য সীমান্ত অতিক্রম করছে, যার অনেকটাই বিনিময় হচ্ছে সোনার মাধ্যমে। ভারতের কড়াকড়ি বৃদ্ধির পটভূমিতে বাংলাদেশ এখন বহুমুখীকরণে মনোযোগ দিচ্ছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে চীনের আমদানির অংশ ২৩ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে, আর ভারতের অংশ কমে এসেছে মাত্র ১১ শতাংশে।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিল রয়েছে—দুই দেশই বিশাল পরিমাণে আমদানি করে, যা তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তারের একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ চীন থেকে বছরে ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করলেও রপ্তানি করে মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার। ভারতের ক্ষেত্রেও চিত্র প্রায় একই: ১২ বিলিয়নের আমদানির বিপরীতে রপ্তানি মাত্র ১.৫ বিলিয়ন ডলার।
এই পরিসংখ্যানগুলো ইঙ্গিত করে যে, বাংলাদেশ ইচ্ছে করলেই আমদানি হ্রাসের হুমকি দিয়ে আলোচনার টেবিলে প্রতিবেশীদের আনতে পারে। যদিও চীনের আমদানিকৃত পণ্যের অধিকাংশই শিল্প ভিত্তিক ও ব্যয়বহুল, ভারত থেকে আমদানিকৃত অধিকাংশ পণ্যের সহজ ও তুলনামূলক সস্তা বিকল্প রয়েছে। এই কারণেই ভারত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুধু বন্ধুত্ব নয়, বরং ‘অনুগত’ সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি শুধু বাণিজ্য সম্পর্কেই নয়, বৃহত্তর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতাও। বাংলাদেশ স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিকভাবে তাকে আর কোণঠাসা করা যাবে না। একটি সাপ্লাই চেইনের সীমিত সিদ্ধান্ত এখন গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য মানচিত্র ও আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্নির্মাণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
*ঈষৎ পরিমার্জিত
লেখক: ইরফানুল হক খান (পান্থ)