
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভোর যেন সবসময় নতুন গল্পের জন্ম দেয়; দু’চোখ ভরা স্বপ্ন, হলের নির্জন রাতের পড়াশোনা, বন্ধুত্বের হাসি, মাঝেমধ্যে অশ্রুসিক্ত হতাশা এবং এগিয়ে যাওয়ার অনিঃশেষ শক্তি। সেই দীর্ঘ পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোনো এক সন্ধ্যায় যখন একজন তরুণ বিসিএসের সোনালি ফলাফলের তালিকায় নিজের নাম খুঁজে পায়, তখন তা আর শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য থাকে না; সে মুহূর্ত হয়ে ওঠে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সম্মিলিত গর্ব, আনন্দ আর অনুপ্রেরণার দীপ্ত উৎসব।
৪৫তম বিসিএস সেই উৎসবের আলো ছড়িয়েছে আরও একবার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। আত্মনিবেদন, অধ্যবসায় আর অগণিত রাতের নিরব সংগ্রামের বিনিময়ে কুবির ৯ জন মেধাবী শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত ক্যাডারে জায়গা করে নিয়েছেন। তাদের সাফল্য যেন ক্যাম্পাসজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া এক নতুন সম্ভাবনার বার্তা; স্বপ্ন সত্যি হয়, যদি তা বুকে আগলে ধরে এগিয়ে যাওয়া যায়।
ক্যাডার সাফল্যে কুবির ৯ শিক্ষার্থী
৪৫তম বিসিএসে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি করেছেন।
প্রশাসন ক্যাডারে সাফল্য অর্জন করেছেন:
গণিত বিভাগের ২০১৪–১৫ শিক্ষাবর্ষের অলি আহমেদ রায়হান, ইংরেজি বিভাগের ২০১৫–১৬ শিক্ষাবর্ষের মো. এমদাদুল হক সরকার, আইসিটি বিভাগের ২০১৪–১৫ শিক্ষাবর্ষের আরাফাত হোসেন মজুমদার, ইংরেজি বিভাগের ২০১৪–১৫ শিক্ষাবর্ষের মেহেদী ইসলাম এবং লোক প্রশাসন বিভাগের ২০১৪–১৫ শিক্ষাবর্ষের মো. রাকিব হোসেন।
কাস্টমস ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছেন: অর্থনীতি বিভাগের ২০১৫–১৬ শিক্ষাবর্ষের আব্দুল্লাহ আল নুমান অন্তর ও ইংরেজি বিভাগের ২০১৫–১৬ শিক্ষাবর্ষের আশরাফুল সৌরভ। শিক্ষা ক্যাডারে সাফল্য পেয়েছেন: ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৪–১৫ শিক্ষাবর্ষের নাজমুল হাসান শিমুল এবং ইংরেজি বিভাগের ২০১৪–১৫ শিক্ষাবর্ষের মাজারুল ইসলাম।
এই নয় কৃতি শিক্ষার্থীর সাফল্য কেবল তাদের ব্যক্তিগত জীবনের জয় নয়; এটি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীর মুখে এনে দিয়েছে গর্বের হাসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি এক উজ্জ্বল সংযোজন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে।
কৃতিদের কণ্ঠে সাফল্যের গল্প
বাবা ও বড় ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি
রেজাল্টের রাতে বন্ধুর ফোনে ঘুম ভাঙে এবং ঘুম ঘুম চোখে রেজাল্ট শীটে প্রশাসন ক্যাডারে নিজের রোল দেখতে পাই। প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না, কিন্তু কয়েকবার চেক করে নিশ্চিত হই। পরিবারকে জানানোর পর তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। বাবা ও বড় ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।
অনার্সের পর বিসিএস প্রস্তুতি শুরু করি এবং করোনার সময়টা ভালোভাবে কাজে লাগাই। নিয়মিত পত্রিকা পড়া ও পত্রিকায় লেখালিখি লিখিত পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। এই দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্বে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনেক শিক্ষক আমাকে অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেলোয়ার হুসাইন স্যারের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। আমার শিক্ষাঙ্গন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগকেও ধন্যবাদ জানাই।
মো. এমদাদুল হক সরকার
(ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৫তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার (সুপারিশপ্রাপ্ত)
সফলতার পথে ধারাবাহিকতা আর লক্ষ্যই সবচেয়ে বড় শক্তি
আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষের শুরু থেকেই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করি। গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ায় গণিত, বিজ্ঞান, কম্পিউটার ও মানসিক দক্ষতার বিষয়ে তুলনামূলক কম সময় লাগে। সেই সময় আমি অন্য বিষয়গুলোতে, বিশেষ করে ইংরেজিতে দুর্বলতা কাটাতে ব্যয় করি।
কোচিং সেন্টারে নিয়মিত ক্লাস না করলেও আমি মডেল টেস্টে নিয়মিত অংশ নিই। এতে নিজের প্রস্তুতির অবস্থান বুঝতে সুবিধা হয়েছে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রস্তুতি গোছানো থাকায় বেশিরভাগ প্রিলিতেই আমি সফল হই। লিখিত পরীক্ষার জন্য প্রচুর লেখার অভ্যাস গড়ে তুলি। দ্রুত ও পরিষ্কার হাতের লেখা ভালো ইমপ্রেশন তৈরি করে। পাশাপাশি ইংরেজি ও গণিতের দক্ষতা আমাকে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রাখে।
আমি মনে করি, বিসিএস একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি ও ধৈর্যের পরীক্ষা। অর্থনৈতিক চাপ না থাকলে সময় নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া যায়, তবে এই দীর্ঘ যাত্রায় সবার হাতে একটি বিকল্প পরিকল্পনা থাকা জরুরি। চাকরির বাজার অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক, কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও সবাই সফল নাও হতে পারে। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে বিকল্প পরিকল্পনা রাখলে মানসিক চাপ কমে এবং মূল লক্ষ্যে মনোযোগ দেওয়া সহজ হয়। সফলতার জন্য ধারাবাহিকতা, লক্ষ্য স্থির রাখা এবং বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই।
আমার লক্ষ্য একজন সৎ, দক্ষ ও আদর্শ প্রশাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং কার্যকর ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের মাধ্যমে দেশ ও সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করা।
অলি আহমেদ রায়হান
(গণিত বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৫তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার (সুপারিশপ্রাপ্ত)
আমরা কুবিয়ান—এই পরিচয়ই আমাদের শক্তি
আমি বিশ্বাস করি, শুধু মন দিয়ে চাইলেই সব পাওয়া যায়—এই ধারণা পুরোপুরি সত্য নয়। চাওয়ার সঙ্গে পরিশ্রম, লেগে থাকা, বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এবং বারবার ব্যর্থ হওয়ার পরও নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি মগ্ন থাকতে হয়। তবেই সাফল্য আসে।
আমার বিসিএস যাত্রা শুরু হয় অনার্স শেষ করার পর। সে সময় শরীফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলি, যিনি বর্তমানে কুমিল্লার জেলা তথ্য অফিসার এবং ৪৩তম বিসিএস থেকে তথ্য ক্যাডারে কর্মরত। তিনি আমাকে শহরে এসে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেন এবং বই কেনার ব্যাপারে গাইডলাইন দেন। একই লক্ষ্য নিয়ে গড়ে ওঠা একটি ভালো গ্রুপের সঙ্গে নিয়মিত পড়াশোনা, সাপ্তাহিক টার্গেট পূরণ ও পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে আমি ধাপে ধাপে প্রস্তুতিকে এগিয়ে নিই।
এ পর্যন্ত আমি পাঁচটি সরকারি চাকরি পেয়েছি। প্রথম চাকরি ছিল এনএসআই-এর ফিল্ড অফিসার হিসেবে। চতুর্থ চাকরিতে প্রথম যোগদান করি এবং বর্তমানে সহকারী পরিচালক হিসেবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে কর্মরত আছি। পঞ্চম চাকরি হিসেবে ৪৫তম বিসিএস থেকে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। আল্লাহর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ভবিষ্যতে যে দায়িত্বই পাই, তা যেন সঠিকভাবে পালন করতে পারি, এই চেষ্টাই থাকবে।
নবীনদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই; হাল ছেড়ে দিও না। যা করবে মন দিয়ে করো। যে সেক্টরের প্রতি টান অনুভব করো, সেদিকেই এগিয়ে যাও। তবে নিজের প্রতি সৎ থেকো। দিনশেষে হিসাব নিজের সাথেই হয়। পুরোপুরি লক্ষ্যে না পৌঁছালেও লেগে থাকতে পারলে সম্মানের সঙ্গে চলার মতো অর্জন অবশ্যই হবে। নিজের, পরিবারের এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়কে গর্বের জায়গায় নিতে চেষ্টা করো। আমাদের একটা ইউনিক পরিচয়—আমরা কুবিয়ান।
মো. রাকিব হোসেন
(লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৫তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার (সুপারিশপ্রাপ্ত)
সবুর, চেষ্টা আর বিশ্বাসেই ক্যাডার হওয়ার গল্প
বাবা অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী হলেও কখনো আমাদের অভাব বুঝতে দেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নিজের খরচ নিজেই চালাতে টিউশন করেছি এবং অনার্স ও মাস্টার্সে ভালো ফলাফল করেছি। বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল, অফার লেটারও পেয়েছিলাম, কিন্তু আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সে পথে এগোতে পারিনি।
বন্ধু তাঞ্জিমের অনুপ্রেরণায় বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করি। তবে ব্যবসার কারণে সেই যাত্রা মাঝপথে থেমে যায়। আমাদের উদ্যোগ ‘রসদবাড়ি.কম’ শুরুতে ভালো চললেও পরে বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে ব্যাংকের চাকরির চেষ্টা করি এবং একের পর এক পরীক্ষায় ব্যর্থ হই। তবুও পরিবার ও কাছের মানুষদের বিশ্বাস আমাকে ভেঙে পড়তে দেয়নি।
ইউসিবিতে চাকরির সময় আনুর সহায়তা ও নতুন স্ট্র্যাটেজিতে পড়াশোনা করে অবশেষে ১৩৬ নম্বর পেয়ে প্রিলিমিনারি পাস করি। লিখিত পরীক্ষার সময়টা ছিল সবচেয়ে কঠিন। সে সময় চাকরি ছেড়ে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা করে পড়েছি। গণিতের পরীক্ষা ভালো না হলেও বিজ্ঞান পরীক্ষায় পরিশ্রম করে ঘাটতি পুষিয়ে দিই। এর মধ্যেই ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে চাকরিও হয়।
ফেব্রুয়ারিতে বিকেবিতে যোগ দিই, আর আজ আমি বিসিএস ক্যাডার। ফলাফল জানাতে গিয়ে আম্মুকে ফোন করলে কান্না চলে আসে; এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আমি বিশ্বাস করি, সবুর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারলে সফলতা আসবেই, ইনশাআল্লাহ।
মেহেদী ইসলাম
(হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যব্যবস্থা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৫তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার (সুপারিশপ্রাপ্ত)
নিয়মিত অধ্যয়ন, শৃঙ্খলা ও মানসিক শক্তিই ছিল সাফল্যের চাবিকাঠি
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হওয়া আমার কাছে শুধু একটি চাকরি নয়—এটি দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, আত্মত্যাগ ও অধ্যবসায়ের ফল। ফলাফলে নিজের রোল দেখার মুহূর্তটি যেন ভোরের আলোর মতো ছিল। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে বছরের পর বছর পড়াশোনা, রাত জাগা, হতাশা আর পরিবারের অবিরাম সমর্থন। ফল প্রকাশের পর বাবা–মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি; মনে হয়েছিল—অবশেষে পেরেছি। রাষ্ট্রের সেবায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে মনে হয়েছে, আল্লাহ আমাকে বড় একটি দায়িত্বের জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন।
নিয়মিত পড়াশোনা, মডেল টেস্ট, শৃঙ্খলিত জীবনযাপন এবং হতাশাকে জয় করার মানসিক শক্তিই ছিল আমার প্রস্তুতির ভিত্তি। আমি পত্রিকা ও সমসাময়িক খবর নিয়মিত পড়েছি, নানা উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি। “Work smarter, not harder”—এই নীতিতে বিশ্বাস করে প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে পড়াশোনা করেছি এবং দুর্বল বিষয়গুলোতে বেশি সময় দিয়েছি। বিজ্ঞান বিভাগের বেসিক শক্ত থাকায় কিছু বিষয়ে তুলনামূলক কম কষ্ট করতে হয়েছে। কুমিল্লার বিসিএস পরীক্ষার্থীদের বন্ধুমহল ও নিয়মিত গ্রুপ স্টাডি আমার প্রস্তুতিকে আরও শক্ত করেছে।
বিসিএস প্রত্যাশীদের জন্য আমার পরামর্শ; নিজের মেধার সর্বোত্তম ব্যবহার করুন, স্পষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে দুর্বল ও শক্ত দিক চিহ্নিত করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করুন। প্রশ্ন বিশ্লেষণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; ডেটা বা চার্টের ওপর অতিনির্ভর না করে সব উৎস থেকে শিখুন। আমি বিশ্বাস করি, অধ্যবসায়ী মানুষ কখনো ব্যর্থ হয় না। চেষ্টা চালিয়ে গেলে ইনশাআল্লাহ সফলতা আসবেই।
বিসিএস ক্যাডার হওয়াই ছিল আমার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন পূরণে পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও পরিকল্পনাই আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। আমার চেয়েও বাবা বেশি খুশি হয়েছেন—সবসময় ছায়ার মতো পাশে থেকেছেন। পরিবার, শিক্ষক, বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আদর্শ পিতার আদর্শ সন্তান হিসেবে দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করাই আমার অঙ্গীকার।
আরাফাত হোসেন মজুমদার
(আইসিটি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৫তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার (সুপারিশপ্রাপ্ত)
বিসিএসের জার্নিতে আমার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল কখনোই হতাশ না হওয়া
আমার বিসিএস যাত্রা শুরু হয় ২০১৯ সালে, সপ্তম সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষার পর। কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, কিন্তু ২০২০ সালে কোভিড–১৯ পরিস্থিতিতে পড়াশোনায় প্রায় এক বছরের বড় বিরতি আসে। তবুও কোভিডের আগের ভালো প্রস্তুতির ভিত্তিতেই অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই।
প্রিলিমিনারির পর এমবিএ পরীক্ষা, ইন্টার্নশিপ আর নানা ব্যস্ততার মাঝেও লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিই। আল্লাহর রহমতে লিখিত পরীক্ষাও পাস করি এবং নন-ক্যাডারে একটি চাকরি পেয়ে বেকারত্ব কাটাতে সক্ষম হই। এরপর ৪৩তম ও ৪৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে ব্যর্থ হই। ব্যর্থতার সঙ্গে কটু কথাও শুনতে হয়েছে, কিন্তু হাল ছাড়িনি। অবশেষে ৪৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই।
এই দীর্ঘ জার্নিতে আমার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল কখনোই হতাশ না হওয়া। ব্যর্থতার পরও নিজেকে বলেছি—সামনে আরও ভালো করবো। আমার কাছে বিসিএস অনেকটা টেস্ট ম্যাচের মতো; দীর্ঘ সময় ধরে খেলার পরই ফল নির্ধারিত হয়। এই পথে অনেকেই নেতিবাচক কথা বলবে, কিন্তু সেগুলো উপেক্ষা করে লেগে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। বাকিটা রিজিকের ফয়সালা। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আর্থিক সমস্যা থাকলেও লক্ষ্য ঠিক রাখতে পারলে ভালো কিছু অর্জন করা সম্ভব। প্রস্তুতির মাঝপথে গ্যাপ দিলে সাফল্যের মাঝেও গ্যাপ চলে আসে—এটা আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছি।
নাজমুল হাসান শিমুল
(ব্যবস্থাপনা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার (সুপারিশপ্রাপ্ত)
বিশ্বাস, অধ্যবসায় আর ত্যাগেই গড়ে উঠেছে আমার বিসিএস পথচলা
সবার আগে মহান আল্লাহর দরবারে অগণিত শুকরিয়া। আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে আমার পরিবারের, বিশেষ করে বড় ভাইয়ের অবদান অপরিসীম। কোচিংয়ের কাউসার ভাইয়ের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ, যিনি সবসময় পরামর্শ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনায় মন দিই। অনার্স পর্যন্ত সবকিছু ভালোই চলছিল। মাস্টার্সে এসে যেন হঠাৎ করেই ছন্দপতন ঘটে। যদিও অনার্স ও মাস্টার্স দুটিতেই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট অর্জন করি, তবুও সেই সময় থেকেই বিসিএসের জগতে প্রবেশ করি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েও বিসিএসের লক্ষ্যে তা ফিরিয়ে দিই।
৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসে প্রস্তুতি ছাড়াই অংশ নিয়ে ব্যর্থ হই। ৪৪তম বিসিএসে সিরিয়াস প্রস্তুতি নিয়েও সফল হতে পারিনি। তবুও ভেঙে পড়িনি। আরও বেশি পরিশ্রম করেছি, নিজের উপর এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখেছি। মাস্টার্স শেষের পর প্রায় আড়াই বছর বেকার থাকলেও মনোবল হারাইনি। সামাজিক নানা প্রশ্ন কষ্ট দিত, কিন্তু লক্ষ্য থেকে সরে যাইনি। এমনকি বিমান বাংলাদেশে চাকরির সুযোগ পেয়েও বিসিএসের স্বপ্নে সেখানে যোগ দিইনি। অসংখ্য ত্যাগের পর আলহামদুলিল্লাহ আজ আমি বিসিএস ক্যাডার। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
নবীনদের উদ্দেশ্যে আমার একটাই কথা; যদি বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ইচ্ছা মনে জাগে, তাহলে নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস রাখতে হবে, অসম্ভব পরিশ্রম করতে হবে এবং লেগে থাকতে হবে। সর্বোপরি সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রাখতে হবে। ইনশাআল্লাহ সফলতা আসবেই। নিজের ভবিষ্যৎ নিজেকেই তৈরি করতে হবে। অধ্যবসায় ছাড়া বিসিএস ক্যাডার হওয়া সম্ভব নয়, এই সত্যটা মাথায় রেখেই এগোতে হবে।
মাজারুল ইসলাম
(ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার (সুপারিশপ্রাপ্ত)
পরিশ্রম ও পরিকল্পনা ঠিক থাকলে সাফল্য আসবেই
অনার্স শেষ করার পর চাকরির প্রস্তুতি নিতে গিয়ে ব্যাংকিং ও বিসিএসের মধ্যে দ্বিধায় ছিলাম, তবে শেষ পর্যন্ত বিসিএসকেই বেছে নিই। করোনাকালীন বন্ধ সময়কে কাজে লাগিয়ে আমি একাগ্রভাবে পড়াশোনা শুরু করি। প্রথম প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় কৌশলগত ভুলের কারণে ব্যর্থ হলেও ভেঙে পড়িনি; বরং নতুন পরিকল্পনা ও ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাই। বিশ্বাস ছিল—পরিশ্রম ও পরিকল্পনা ঠিক থাকলে সাফল্য আসবেই। এই পথে পরিবার ও বন্ধুদের সমর্থন ছিল আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।
অর্থনীতির শিক্ষার্থী হিসেবে দেশের রাজস্ব ব্যবস্থা, সরকারি অর্থায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে একাডেমিকভাবে কিছুটা পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি, যা পরবর্তীতে আমাকে বিসিএস কাস্টমস ক্যাডারে আগ্রহী করে তোলে। আমি বিশ্বাস করি, এই আগ্রহ, প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান এবং সরকার প্রদত্ত প্রশিক্ষণের সমন্বয়ে নিজেকে একজন দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো। দেশের রাজস্ব খাতে কার্যকর ভূমিকা রেখে জাতীয় উন্নয়নের অংশীদার হতে পারবো।
নবীনদের জন্য আমার পরামর্শ; নিজের জীবনে কী করতে চাও, সেটা যতটা সম্ভব আগেভাগেই নির্ধারণ করা বুদ্ধিমানের কাজ। অনেক সময় দেরিতে আসা দিক অন্বেষণ সচরাচর বিচক্ষণতার পরিচয় দেয় না। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে কৌশলী এবং অধ্যবসায়ী হতে হবে। সেই সঙ্গে তোমাকে সমর্থন যোগাবে এমন মানুষদের সঙ্গ রাখা অত্যন্ত জরুরি।
আব্দুল্লাহ আল নুমান অন্তর
(অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৫তম বিসিএসে কাস্টমস ক্যাডার (সুপারিশপ্রাপ্ত)
বিসিএসে সফলতার চাবিকাঠি: ধৈর্য, কৌশল ও আত্মবিশ্বাস
আমার বাবা-মা আজীবন আমাকে উৎসাহ, সাহস ও নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছেন; তাদের ত্যাগই আমার সফলতার প্রধান ভিত্তি। ভাইবোনেরা সবসময় ছায়ার মতো পাশে ছিল। প্রতিটি মুহূর্তে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন আমার সহধর্মিণী। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে আমাদের বিয়ে হলেও বেকার সময়জুড়ে সে আমাকে সাহস, ভরসা ও সমর্থন দিয়েছেন। শ্বশুর-শাশুড়ি, শিক্ষকবৃন্দ ও বন্ধুদের সহযোগিতার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।
মহান আল্লাহর রহমত, সবার দোয়া ও ভালোবাসা এবং কৌশলী পড়াশোনার ফলে আমি টানা তিনটি বিসিএসে ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। বিসিএস আসলে কঠিন নয়, এতে সবচেয়ে বেশি দরকার তিনটি জিনিস: সীমাহীন ধৈর্য, নিয়মিত ও কৌশলী পড়াশোনা, এবং নিজের উপর আত্মবিশ্বাস। এছাড়া ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা স্পষ্ট থাকা জরুরি। ইংরেজিতে ফ্রি-হ্যান্ড রাইটিংয়ের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সর্বশেষে, সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা এবং নিজের নিরন্তর প্রচেষ্টাই পারে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে।
আশরাফুল সৌরভ
(ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৫তম বিসিএসে কাস্টমস ক্যাডার (সুপারিশপ্রাপ্ত)