
বাংলা সাহিত্যের অগ্রদূত, মুসলিম সাহিত্য জাগরণের পথিকৃৎ এবং কালজয়ী উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’-এর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের ১৭৮তম জন্মবার্ষিকী আজ (১৩ নভেম্বর) বৃহস্পিতবার রাজবাড়ীতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপিত হচ্ছে।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের পদমদী গ্রামে অবস্থিত মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে সকাল থেকে চলছে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি। এ উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন, বাংলা একাডেমি, মীর মশাররফ হোসেন সাহিত্য পরিষদ, মীর মশাররফ হোসেন ডিগ্রি কলেজসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়ায় নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সাহিত্যসম্রাট মীর মশাররফ হোসেন। তাঁর পিতা ছিলেন সৈয়দ মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাতা দৌলতুন্নেছা। সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ মুসলিম কথাশিল্পী।
শিক্ষাজীবন শুরু করেন কুষ্টিয়ায়, পরে রাজবাড়ীর পদমদী ও কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। জীবনের বড় অংশ কাটান ফরিদপুরের নবাব এস্টেটে চাকরি করে; কিছু সময় অবস্থান করেন কলকাতায়ও।
১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাজবাড়ীর পদমদী গ্রামে নিজ পৈতৃক নিবাসে তিনি ইন্তেকাল করেন এবং সেখানেই সমাহিত হন। তাঁর স্মৃতির সংরক্ষণে পরবর্তীতে গড়ে তোলা হয় “মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র”।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মুস্তাফিজুর রহমান জানান, “জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন ও বাংলা একাডেমির যৌথ উদ্যোগে সাহিত্য সম্রাটের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।”
অনুষ্ঠানের সূচি অনুযায়ী সকাল ১০টায় সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের মধ্য দিয়ে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। বেলা ১১টায় স্মৃতি কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা ও সেমিনার। সভায় সভাপতিত্ব করেন রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার। প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলা একাডেমির সচিব (উপসচিব) ড. মো. সেলিম রেজা। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির পরিচালক সমীর কুমার সরকার ও ড. সরকার আমিন।
প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ। এছাড়া আলোচনায় অংশ নেন মীর মশাররফ হোসেন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. কামাল হোসেন খান, সহকারী অধ্যাপক মো. শাহজালাল, রাজবাড়ী জেলা মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি সংসদের সভাপতি সালাম তাসির এবং বালিয়াকান্দি সাহিত্য পরিষদের সভাপতি মুন্সী আমীর আলীসহ অনেকে।
মীর মশাররফ হোসেন একাধারে ছিলেন ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও কবি। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিষাদ সিন্ধু, জমিদার দর্পণ (১৮৭৩), উদাসী পথিকের মনের কথা (১৮৯০), রত্নবতী, গাজী মিয়ার বস্তানী ও বিবি কুলসুম (১৯১০)। আত্মজীবনীমূলক রচনায় রয়েছে আমার জীবনী, আর ধর্মীয় ও প্রবন্ধমূলক রচনায় ছোটদের মহানবী, মৌলুদ শরীফ, বিবি খোদেজার বিবাহ, সঙ্গীত লহরী প্রভৃতি।
সর্বমোট ৩৭টি গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাঙালি মুসলমান সমাজে নবজাগরণের সঞ্চার ঘটায় এবং সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও মানবিক চেতনায় নতুন উচ্চতা এনে দেয়।
১৯৭৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে নির্মিত হয় একটি আবাসিক হল, যা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ছাত্রাবাস হিসেবে পরিচিত।
মীর মশাররফ হোসেন সাংবাদিক হিসেবেও সক্রিয় ছিলেন। তিনি সংবাদ প্রভাকর ও গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং মুসলমান সম্পাদিত প্রথম সাহিত্য সাময়িকী আজীজন নেহার নিজেই সম্পাদনা করতেন।
জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাজবাড়ীর পদমদী আজ পরিণত হয়েছে সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনমেলায়। তাঁর সাহিত্যচর্চা, মানবিক মূল্যবোধ ও সমাজচেতনা আজও নবীন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এই অমূল্য সম্পদ বাঙালি জাতির হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।