পাকিস্তানের লাহোরে নবম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় দারুণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন শিখ সম্প্রদায়ের ছাত্র অনকর সিং। সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য যেখানে সাধারণত বিকল্প বিষয় দেওয়া হয়, সেখানে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বেছে নিয়েছেন ইসলামি স্টাডিজ এবং কোরআনের অনুবাদ। এই দুই বিষয়ে তিনি অর্জন করেছেন অসাধারণ ফলাফল—ইসলামি স্টাডিজে ১০০-এর মধ্যে ৯৮ এবং কোরআনের অনুবাদে ৫০-এর মধ্যে ৪৯।
মাত্র ১৫ বছর বয়সী অনকর মোট ৫৫৫-এর মধ্যে ৫৫৪ নম্বর পেয়ে পুরো পরীক্ষায় শীর্ষ পর্যায়ের ফলাফল করেন। শিক্ষাঙ্গনে এই অর্জন বিশেষ আলোচনার জন্ম দিয়েছে, কারণ লাহোর বোর্ডের এই পরীক্ষায় সামগ্রিক পাশের হার ছিল মাত্র প্রায় ৪৫ শতাংশ। একদিকে যখন হাজারো শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে, তখন একজন সিখ ছাত্র ইসলামি বিষয় বেছে নিয়ে এমন সাফল্য অর্জন করায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের কাছ থেকেও ব্যাপক প্রশংসা কুড়াচ্ছেন।
পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম তার ফলাফলকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছে। সামা টিভি অনকরকে অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে, একজন সিখ ছাত্রের ইসলামি স্টাডিজে সাফল্য প্রমাণ করে জ্ঞান অর্জনে ধর্মীয় সীমানা কোনো বাধা নয়। ফ্রি প্রেস জার্নাল বলেছে, অনকর শুধু নিজেকে নয়, গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন আলোয় তুলে ধরেছেন।
অনকর সিং সামা টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের সাফল্যের কৃতিত্ব দিয়েছেন শিক্ষক ও পরিবারের প্রতি। তিনি বলেন, “এই সাফল্য সম্ভব হয়েছে আমার শিক্ষকদের দিকনির্দেশনা, বাবা-মায়ের দোয়া ও নিরলস উৎসাহের কারণে।” ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে অনকর জানিয়েছেন, তিনি চিকিৎসক হতে চান। তার অনুপ্রেরণা তার বাবা ডা. মিম্পাল সিং, যিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৪ সালে পাকিস্তান সরকারের দেওয়া রাষ্ট্রীয় পদক তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পেয়েছিলেন। ছেলের সাফল্যে গর্বিত হয়ে ডা. মিম্পাল সিং বলেন, “আজ শুধু আমাদের পরিবার নয়, গোটা শিখ সম্প্রদায় এবং পাকিস্তানের মানুষ এই অর্জন উদযাপন করছে। কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর ইতিবাচক মনোভাব থাকলে জীবনে যেকোনো সাফল্য সম্ভব।”
লাহোর বোর্ডের নবম শ্রেণির পরীক্ষার সামগ্রিক চিত্র অবশ্য ছিল হতাশাজনক। এ বছর মোট ৩ লাখ ৮ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাশ করেছে মাত্র ১ লাখ ৩৮ হাজার। ফেল করেছে প্রায় ১ লাখ ৬৯ হাজার শিক্ষার্থী। পাশের হার ছিল মাত্র ৪৫ শতাংশ। ছেলেদের ক্ষেত্রে ফেল করার হার ৬৫ শতাংশ এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ৪৭ শতাংশ। গ্রুপভিত্তিক ফলাফলে আর্টস গ্রুপে ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে, যেখানে ছেলেদের ফেল ৭৯ শতাংশ এবং মেয়েদের ৫৩ শতাংশ। বিজ্ঞান গ্রুপেও ফেল করেছে ৫৩ শতাংশ শিক্ষার্থী, ছেলেদের ক্ষেত্রে ৬২ শতাংশ এবং মেয়েদের ৪৪ শতাংশ।
প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক ভালো ফল করেছে—যেখানে পাশের হার ছিল ৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারি স্কুলগুলোর চিত্র ছিল উল্টো, সেখানে ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য। শিক্ষামন্ত্রী রানা সিকান্দার হায়াত অনকর সিংয়ের ফলাফলকে অভিনন্দন জানিয়ে এক্স-এ লেখেন, “ভালো কাজ।” তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের দুর্বল ফলাফল নিয়ে। তিনি মন্তব্য করেন, মুসলিম শিক্ষার্থীরা যেখানে ধর্মীয় বিষয়ে ফেল করছে, সেখানে একজন সিখ ছাত্র ইসলামি স্টাডিজে সর্বোচ্চ ফল করেছে—এটি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বড় শিক্ষা।
শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, এ বছরের ফলাফল শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সক্ষমতার প্রতিফলন। তিনি জানান, পাঞ্জাবের বিভিন্ন বোর্ডে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকা নকল চক্র বা ‘বুটি মাফিয়া’ দমনের কারণে এবার ফলাফল অনেক বেশি বাস্তবসম্মত হয়েছে। যদিও পাশের হার কমে এসেছে, তবে এটি পরীক্ষায় স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দিয়েছে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অনকর সিংয়ের সাফল্য শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং এক বিরল আন্তঃধর্মীয় বার্তা। একজন সিখ ছাত্র ইসলামি স্টাডিজ ও কোরআনের অনুবাদে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, যা পাকিস্তানের শিক্ষাজগতে নতুন আলো জ্বালিয়েছে।