তাপ বিকিরণের ১৬৫ বছরের পুরনো সূত্র ভেঙে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলেন পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক দল। তাদের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার ভবিষ্যতে সৌরশক্তি সংগ্রহ, তাপ পরিবহন এবং ইনফ্রারেড সেন্সরে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটাতে পারে।
এই গবেষণাপত্রটি ২০২৫ সালের ২৩ জুন Physical Review Letters–এ প্রকাশিত হচ্ছে, যা জার্নালটির “Editors’ Suggestion” হিসেবেও মনোনীত হয়েছে।
এই গবেষণায় অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী প্রমিত ঘোষ, যিনি বর্তমানে পেন স্টেটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করছেন। তাঁর গবেষণা বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে।
১৮৬০ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী গুসটাভ কিরখফ একটি সূত্র দেন, যেখানে বলা হয়—একটি বস্তুর তাপ বিকিরণ ক্ষমতা ও শোষণ ক্ষমতা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কোণে সমান হবে। এটাই Kirchhoff’s Law of Thermal Radiation।
বিগত দশকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছিলেন, এই সূত্রটি ভাঙা সম্ভব। যদিও কয়েক বছর আগে এই সূত্র ভাঙার প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছিল, কিন্তু তাতে শক্তিশালী ও ব্যবহারোপযোগী বৈষম্য দেখা যায়নি। তবে পেন স্টেট গবেষকদের আবিষ্কারে ০.৪৩ মাত্রার অসমতা (emissivity ≠ absorptivity) ধরা পড়েছে, যা এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বিস্তৃত তরঙ্গদৈর্ঘ্য জুড়ে কার্যকর।
গবেষক দল একটি নতুন মেটামেটেরিয়াল তৈরি করেছেন, যা মাত্র ২ মাইক্রোমিটার পুরু এবং পাঁচটি সেমিকন্ডাক্টর স্তর দিয়ে তৈরি। এই উপাদানটি শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের অধীনে সাধারণ বস্তুগুলোর মতো আচরণ করে না—এটি বেশি তাপ বিকিরণ করে, কিন্তু কম শোষণ করে।
এই গবেষণার জন্য তারা তৈরি করেছেন একটি বিশেষ যন্ত্র—Angle-Resolved Magnetic Thermal Emission Spectrophotometer, যা নির্দিষ্ট কোণ ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যে তাপ বিকিরণ পরিমাপে সক্ষম। এই যন্ত্রটির সাহায্যেই এতটা শক্তিশালী “nonreciprocity” ধরা পড়েছে।
এই গবেষণা শুধু তাত্ত্বিক নয়, বরং ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও বহুবিধ সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সৌরপ্যানেল সাধারণত সূর্যের আলো শোষণের পাশাপাশি কিছু তাপ আবার বিকিরণ করে। Kirchhoff-এর সূত্র অনুযায়ী, এই বিকিরণ ফিরিয়ে দিতে হয় সূর্যের দিকে, যা একরকম অপচয়। নতুন এই আবিষ্কারের মাধ্যমে সেই বিকিরিত শক্তিকে ভিন্ন দিকে পাঠিয়ে অন্য একটি প্যানেলে শোষণ করানো সম্ভব—ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দক্ষতা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।
গবেষণাপত্রটির সহ-লেখক হিসেবে প্রমিত ঘোষের নাম যুক্ত থাকায় এটি বাংলাদেশের বিজ্ঞানী সমাজের জন্য এক গর্বের মাইলফলক। প্রমিত ও তাঁর দল আমাদের দেখালেন—নতুন চিন্তা, সাহসী পদক্ষেপ এবং সৃষ্টিশীল প্রযুক্তির মাধ্যমে শতাব্দীপ্রাচীন বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসও বদলে দেওয়া সম্ভব।