২৩ জুন ১৭৫৭। বাংলার ভাগ্য বদলে দেওয়া সেই দিন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন, রবার্ট ক্লাইভের বিজয় আর মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা — আমরা সবাই জানি। সেই পলাশীর যুদ্ধে বাংলার হার শুধু মাটির লড়াই ছিল না, ছিল ভেতরের শত্রুদের হাত মেলানোর এক নির্মম গল্প।
আর ইতিহাসের মজার ব্যাপার হলো, এই ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয়নি। এই বিশ্বাসঘাতকতা আজও শেষ হয়নি। শুধু নাম আর ঠিকানা বদলেছে। সেই মীর জাফর এখন আর মীর জাফর নেই। কখনও সে কোনো কর্পোরেট অফিসে, কখনও মন্ত্রীসভায়, কখনও সিক্রেট সার্ভিসের ভেতরে ঢুকে বসে আছে।
দেখুন ইরানের ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানে ধরা পড়েছে মোসাদের হয়ে কাজ করা একদল এজেন্ট। ভয়াবহ ব্যাপার হলো — এরা সবাই ইরানেরই নাগরিক। জন্মভূমির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা, দেশের নিরাপত্তা বিক্রি করে, মুষ্টিমেয় ডলারের লোভে তারা শত্রু রাষ্ট্রের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেছে। ঠিক যেমন মীর জাফর করেছিল।
আজ ২৬৮ বছর পরেও আমরা সেই একই গল্প শুনছি। শুধু এখন যুদ্ধের মাঠ বদলে গেছে। অস্ত্র বদলে গেছে ল্যাপটপ আর সাইবার হামলায়। আর মীর জাফররাও আধুনিক হয়েছে। তারা পাসপোর্টের পেছনে দেশের পতাকা রাখে, আর ভেতরে শত্রুর পতাকা। কখনো ডলার, কখনো পদ, কখনো ক্ষমতার লোভে নিজেদের আত্মা বিক্রি করে দেয়। বিশ্বের সব দেশের মতো বাংলাদেশেও গুজব, অভিযোগ আর শঙ্কা আছে। RAW-এর (ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) এজেন্ট ঘাপটি মেরে থাকতে পারে, থাকতে পারে আমেরিকান দালাল। কখনো হয়তো সরকারি চাকরিতে, কখনো বড় কর্পোরেট অফিসে, মিডিয়ার ভেতরে, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও।
এটাও অস্বীকার করা যায় না — বিগত সময়ে নানা সংবাদের পাতায় ‘র’ কানেকশন’ “মার্কিন অপতৎপরতা”, ‘বিদেশি গোয়েন্দা তৎপরতা’ আর ‘দেশীয় সুবিধাভোগীদের’ নাম এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের ভেতরেই কি নতুন কোনো মীর জাফর জন্ম নিচ্ছে?
পলাশীর যুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল ভেতরের বিশ্বাসঘাতক। ইরানের মতো বাংলাদেশেও যদি কেউ ভেতরে বসে দেশের স্বার্থ বিক্রি করে, শত্রুর হয়ে কাজ করে — তাহলে বুঝতে হবে, পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়নি। শুধু ক্লাইভের পোশাক বদলে গেছে, আর মোসাদ, র’-এর মতো নাম এসেছে।
দেশপ্রেমের নামে যারা ভেতরে ভেতরে দেশবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত, তারা আসলে আজকের মীর জাফর। আর এই মীর জাফররা যতদিন থাকবে, ততদিন পলাশী বারবার ঘটবে।
পলাশীর মূল শিক্ষা হলো — শত্রুর ভয় নেই যতটা, যতটা ভয় ভেতরের বিশ্বাসঘাতক। আজ বাংলাদেশ, ইরান, ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া — প্রতিটি দেশেই এই মীর জাফরদের ধরার সময়।
ইরানের এই ঘটনা আমাদের জন্য অ্যালার্ম। কারণ যারা নিজের দেশ বিক্রি করে দিতে পারে, তারা বিশ্বের যেকোনো কোণায় থাকতে পারে।
পলাশীর আম বাগান আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয় — শত্রু আসে বাইরে থেকে, কিন্তু পতন ঘটে ভেতর থেকে।