ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে টানা ছয়দিনের তীব্র সংঘর্ষের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে কি না, তা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নানা ধরনের মিশ্র সংকেত দিয়ে যাচ্ছেন।
বুধবার হোয়াইট হাউসের লনে ৮৮ ফুট বা ২৭ মিটার উঁচু দুটি পতাকা স্ট্যান্ড বসানোর সময় সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন, যুক্তরাষ্ট্র কি ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাবে?
এর উত্তরে ট্রাম্প বলেন, “তোমরা জানো না আমি এটা করব কি না। আমি করতেও পারি, নাও করতে পারি। কেউ জানে না আমি কী করব। তবে এটা বলতে পারি — ইরানের অবস্থা ভালো না, আর তারা আলোচনায় বসতে চায়।”
পরে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে জুভেন্টাস ফুটবল দলের সঙ্গে ছবি তোলার সময় আবারও জানান, এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। বলেন, “আমি কী করব তা নিয়ে কিছু পরিকল্পনা আছে, তবে এখনো চূড়ান্ত করিনি। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করি একদম শেষ মুহূর্তে। কারণ যুদ্ধের মতো ব্যাপারে পরিস্থিতি বদলে যায়। এক মুহূর্তে এক রকম, পর মুহূর্তেই অন্যরকম।”
ট্রাম্পের এই দ্বিধা যুদ্ধক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে এবং দেশের ভেতরও তীব্র বিতর্ক দেখা দিয়েছে। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট দলীয় কয়েকজন আইনপ্রণেতা ট্রাম্পের একক সিদ্ধান্তে যুদ্ধে জড়ানোর ক্ষমতা সীমিত করতে বিল উত্থাপন করেছেন।
এদিকে রক্ষণশীল বিশ্লেষক টাকার কার্লসন এক ভিডিও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন, যেখানে ডানপন্থী সিনেটর টেড ক্রুজের সঙ্গে ইরানের শাসন ব্যবস্থা বদলের বিষয়ে বিতর্ক করেন।
ট্রাম্পকে এ বিষয়ে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “আমি যুদ্ধ করতে চাই না। আমি কোনো যুদ্ধ খুঁজছি না। তবে যদি যুদ্ধ না করা আর ওদের পারমাণবিক অস্ত্র থাকা — এই দুইয়ের মধ্যে একটা বেছে নিতে হয়, তবে যা করার তা করতে হবে। তবে হতে পারে যুদ্ধের দরকার হবে না। মনে রেখো, আমরা এখনো যুদ্ধ করছি না।”
পেন্টাগন থেকে জানানো হয়েছে, প্রেসিডেন্টের নির্দেশ এলে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ কংগ্রেসে বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যা বলেন, তার গুরুত্ব আছে। বিশ্ব সেটা বোঝে। আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো — যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা। আমরা সেটাই করছি।”
ট্রাম্প আবারো দাবি করেন, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির খুব কাছে চলে গিয়েছিল। তিনি বলেন, “২০ বছর, তার চেয়েও বেশি সময় ধরে বলে আসছি, ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকা চলবে না। আমি অনেক দিন ধরেই এটা বলে আসছি। আর আমার মনে হচ্ছে, তারা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটা পেয়ে যেত।”
যদিও মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান টুলসি গ্যাবার্ড মার্চ মাসে কংগ্রেসে জানিয়েছিলেন, “ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে না।” যদিও পরে প্রেসিডেন্টের অবস্থানের সঙ্গে মিল রেখে তিনি সেই বক্তব্য থেকে সরে আসেন।
ইসরায়েলও এই আশঙ্কা থেকেই প্রথম হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে। যদিও ইসরায়েলের গোপন পারমাণবিক অস্ত্র মজুত রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
ইসরায়েলের ১৩ জুনের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র-ইরান আলোচনায় স্থবিরতা নেমে আসে। নির্ধারিত বৈঠক বাতিল হয়। ওই হামলায় ইরানের কয়েকজন পারমাণবিক আলোচক, সামরিক নেতা ও বিজ্ঞানী নিহত হন।
ট্রাম্প বলেন, “এত মৃত্যু-ধ্বংসের আগে কেন আমার সঙ্গে আলোচনায় বসলে না? আমি লোকজনকে বলেছি — দুই সপ্তাহ আগে আলোচনায় বসলে পারতে। তোমাদের দেশটা থাকত। এখন খুবই দুঃখ লাগে এসব দেখে।”
তিনি জানান, সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পর ইরান তার সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেছে। ট্রাম্প বলেন, “আমি বলেছি — এত দেরিতে কথা বলার সময় না। এখন আর এক সপ্তাহ আগের মতো অবস্থা নেই।”
এর আগের দিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে হত্যা করা হতে পারে এবং ইরানের ‘নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ’ করা উচিত।
খামেনি পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে নামলে এর “গভীর এবং অপূরণীয় পরিণতি” হবে।
এদিকে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাজিদ তাখত-রাভাঞ্চি সিএনএন-এ বলেন, “আমরা কারও কাছে যেতে চাই না। আমরা নিজেদের রক্ষা করছি। হুমকির মুখে আলোচনা হয় না। যখন প্রতিদিন আমাদের ওপর বোমা পড়ছে, তখন আলোচনা করা যায় না। আমরা কারও কাছে ভিক্ষাও চাইছি না।”
তিনি আরও বলেন, “যদি আমেরিকানরা সরাসরি লড়াইয়ে আসে, তাহলে আমাদের হাত বাঁধা থাকবে না। দেশের মানুষ ও স্বার্থ রক্ষায় যা প্রয়োজন তা-ই করা হবে।”
বুধবার ট্রাম্প আবারও নিজের অবস্থান জানিয়ে বলেন, “নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ — এর মানে হচ্ছে, আমি আর নিতে পারছি না। আমি শেষ। এর পর আমরা ওদের সব পারমাণবিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেব।”
তিনি ইরানকে দোষারোপ করে বলেন, “৪০ বছর ধরে তারা বলে আসছে — আমেরিকাকে ধ্বংস করো! ইসরায়েলকে ধ্বংস করো! যাদের পছন্দ না তাদের মেরে ফেলো। ওরা ছিল স্কুলের মাস্তান। এখন আর মাস্তানি করতে পারছে না।”
ওভাল অফিসে ট্রাম্প বলেন, “আমরা যুদ্ধবিরতির খোঁজে নই। আমরা চাই সম্পূর্ণ বিজয়। জানো বিজয়টা কী? পারমাণবিক অস্ত্র না থাকা। এটাই চূড়ান্ত জয়।”
তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, সামনের সপ্তাহ “খুব বড় কিছু” হতে যাচ্ছে। তবে ঠিক কী হবে তা জানাননি।
এদিকে ইরানে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪০ জন, যার মধ্যে ৭০ নারী ও শিশু রয়েছে।