এখন চলছে আরবি রজব মাস। আল্লাহ তাআলা বারো মাসের মধ্যে চারটি মাসকে ‘আশহুরে হুরুম’ তথা সম্মানিত মাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
“নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারোটি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে। সুতরাং তোমরা এই মাসসমূহে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।”
(সূরা তাওবা: ৩৬)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
“বারো মাসে বছর। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক: যিলকদ, যিলহজ্ব, মহররম এবং চতুর্থটি হল রজব, যা জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস।” (সহীহ বুখারী ২/৬৭২)
উলামায়ে কেরাম বলেছেন, এই চারটি মাসে ইবাদতের প্রতি যত্নবান হলে বাকি মাসগুলোতেও ইবাদতের তাওফীক হয়। একইভাবে, এই মাসগুলোতে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারলে, অন্যান্য মাসেও গুনাহ পরিহার করা সহজ হয়। (আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/১১১; মাআরিফুল কুরআন ৪/৩৭২)
‘রজব’ শব্দটি আরবি ‘তারজীব’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ সম্মান বা মহিমান্বিত করা। জাহেলি যুগে আরবরা এই মাসকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে পালন করত। তারা রজব মাসে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ রাখত এবং এটিকে শান্তির মাস হিসেবে গণ্য করত।
“রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস এবং রমজান আমার উম্মতের মাস।” (আল-বাইহাকি)
বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরো রজব মাসজুড়ে বেশি বেশি বরকতের দোয়া পড়তে বলেছেন । তাহলো-
اَللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِىْ رَجَبَ وَ شَعْبَانَ وَ بَلِّغْنَا رَمَضَانَ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা বারাকলানা ফি রাজাবা ওয়া শাবানা ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি রজব ও শাবান মাসকে আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং আমাদেরকে রমজান মাস পর্যন্ত (হায়াত দিন) পৌঁছে দিন।’অন্য হাদিসে এসেছে- ‘যে ব্যক্তি রজব মাসে (ইবাদত দ্বারা অন্তরের) জমিন চাষাবাদ করল না আর শাবান মাসে (ইবাদতের মাধ্যমে মনের) জমিন আগাছামুক্ত করল না; সে রমজান মাসে (ইবাদতের) ফসল তুলতে পারবে না।’ (বায়হাকি)
ইসরা ও মিরাজের স্মৃতি:
রজব মাসের এক রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইসরা ও মিরাজের অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। অনেকে ২৭ রজব এ ঘটনা হয়েছিল বলে নির্ধারণ করেন। এ রাতে তিনি মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং সেখান থেকে সপ্ত আকাশ ভ্রমণ করেন। এটি ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
ইসলাম পূর্ব জাহেলি যুগে রজব মাসে মুশরিকদের মধ্যে স্বীয় দেবতা বা প্রতীমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু যবাই করার একটি রেওয়াজ ছিল, যা ‘আতীরা’ নামে পরিচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ প্রথা নিষিদ্ধ করেছেন:
“ইসলামে ‘ফারা’ (উট বা বকরির প্রথম বাচ্চা প্রতীমার উদ্দেশ্যে) জবাই করার কোনো প্রথা নেই এবং ‘আতীরা’ও নেই।” (সহীহ বুখারী ২/৮২২)
বর্তমানে রজব মাসে বিভিন্ন মাজার ও ওরসে শিরকী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বিশেষ করে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রাহ.)-এর ওফাত উপলক্ষে যে ‘উরস’ হয়, সেখানে পশু জবাই এবং বিভিন্ন বিদআত প্রচলিত হয়েছে। এগুলো ইসলামের মৌলিক শিক্ষা এবং তাওহীদের বিপরীত।
বাজারে প্রচলিত অনেক বই-পুস্তকে রজব মাস উপলক্ষে বিশেষ নামায ও রোজার যে বিবরণ দেওয়া হয়, তা ভিত্তিহীন। শরীয়তের দৃষ্টিতে এসব মনগড়া আমল গ্রহণযোগ্য নয়। ফরজ ইবাদতের প্রতি যত্নবান হওয়া এবং নফল ইবাদত বাড়ানোই এ মাসে সঠিক পন্থা।
রজব মাসের একটি জাহেলী কুসংস্কার
আজকাল রজব মাসে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রাহ.-এর মাযারে তাঁর ওফাত উপলক্ষে যে ‘উরস’ হয় সেখানে এমন অনেক পশু জবাই করা হয় যা মূর্খ লোকেরা হযরত খাজা রাহ. বা তাঁর মাযারের নামে মান্নত করে থাকে। জাহেলী যুগের ‘ফারা’, ‘আতীরা’ আর বর্তমানের এসব জবাইকৃত পশুর মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কারো নামে মান্নত করা, তা যদি পীর-বুযুর্গের নামেও হয় তবুও তা শিরক। আমাদের দেশেও খাজা আজমীরী রাহ.-এর ওফাতকে কেন্দ্র করে জাহেল লোকেরা এমন সব রসম-রেওয়াজ উদ্ভাবন করেছে যা কঠোরভাবে পরিহার করে চলা উচিত। বিভিন্ন স্থানে লাল কাপড়ে মোড়ানো বিরাট ‘আজমীরী ডেগ’ বসানো হয়। কোথাও কোথাও মাযারের আদলে অস্থায়ী মাযার স্থাপন করা হয়। এরপর খাজা আজমীরী রাহ.-এর উদ্দেশ্যে নযর-নিয়ায ও মান্নতের নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা, চাল-ডাল ইত্যাদি ওঠানো হয়। যা দেওয়াও হারাম এবং ওখান থেকে কিছু খাওয়াও হারাম। যারা এগুলো উঠায় তারা এগুলো দিয়ে আনন্দ-ফূর্তির আয়োজন করে। ঢোল-তবলা ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে নাচ-গানের আসর বসায়। যেখানে নারী-পুরুষ একসঙ্গে নাচ-গান ও খাওয়া দাওয়ায় অংশ নেয়, অবাধে মেলামেশা করে এবং নানা ধরনের গর্হিত কাজ করে থাকে, যা নিঃসন্দেহে হারাম।
অথচ হযরত খাজা আজমীরী রাহ. মানুষকে শিরক থেকে মুক্ত করতে ভারত বর্ষে এসেছিলেন। তাওহীদ ও সুন্নতের শিক্ষা দিতে এসেছিলেন। তাঁর সেই শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ করার তাওফীক আল্লাহ তাআলা আমাদের দান করুন এবং কুসংস্কার ও রসম-রেওয়াজ থেকে আমাদের ঈমান ও আমলের হেফাযত করুন।
রজব মাস হচ্ছে ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির একটি বিশেষ সময়। এই মাস থেকে শুরু করে শাবান এবং রমজান পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ইবাদতের মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি করা যায়। তাই আমাদের উচিত, রজব মাসের ফজিলত সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং এই সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানো।
Leave a Reply