দেশজুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সিকে ঘিরে। কোটি টাকার গ্রাহক অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা দায়েরের পর তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অথচ এই কোম্পানির শীর্ষ কর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান বিন রশিদ তার পুরো পরিবারসহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, এমনটাই জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
শনিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’-এর অফিস, থেমে যায় তাদের ওয়েবসাইট ও সেবা। পরদিন সকালে বিপুল সংখ্যক গ্রাহক ও পার্টনার এজেন্সি অফিসে এসে দেখেন, বন্ধ গেট আর কোন সাড়া নেই ভেতর থেকে। দেশি-বিদেশি টিকিট বুকিং, হোটেল রিজার্ভেশন, ট্যুর প্যাকেজ ও ভিসা প্রসেসিংয়ের নাম করে যারা হাজারো গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠান এখন কার্যত উধাও।
রোববার (৩ আগস্ট) ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, অন্তত ১৭টি ট্রাভেল প্রতিষ্ঠান ও শতাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ।
ঘটনার সূত্রপাত শনিবার রাতেই, যখন বিপুল সরকার নামে এক গ্রাহক মতিঝিল থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। তার অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ প্রথমে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে— হেড অব ফাইন্যান্স সাকিব হোসেন (৩২), চিফ কমার্শিয়াল অফিসার সাঈদ আহমেদ (৪০) ও চিফ অপারেটিং অফিসার এ কে এম সাদাত হোসেন (৩২)।
মামলার অন্যান্য আসামির মধ্যে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির এমডি সালমান বিন রশিদ শাহ সাঈম এবং তার বাবা এম এ রশিদ। পুলিশ জানিয়েছে, বাকি দুজনের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে এবং তাদের গ্রেপ্তারে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য অনুযায়ী, অনেকে একাধিক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বুকিংয়ের জন্য কয়েক লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন। কেউ কেউ আবার পুরো ট্যুর প্যাকেজের মূল্য পরিশোধ করেও সেবা পাননি। গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ ২ আগস্ট পর্যন্ত বুকিং নিয়েছে, কিন্তু ৩ আগস্ট সকাল থেকে কেউই ফোনে বা সরাসরি যোগাযোগ করতে পারছেন না।
এজেন্সির একটি অংশ ২০২৩ সালের মধ্যেই আর্থিক সংকটে পড়েছিল বলে অনেকে জানিয়েছেন। কিন্তু তারা অব্যাহতভাবে বুকিং নিয়ে যাচ্ছিল এবং শেষপর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম গুটিয়ে পালিয়ে যায়।
এ ঘটনায় দেশের ট্রাভেল ও ট্যুরিজম খাতে গ্রাহক আস্থার ওপর বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস (বাটা) তদন্ত শুরু করেছে।
ফ্লাইট এক্সপার্টের মতো কোম্পানিগুলোর কোনো নিয়মিত তদারকি না থাকা, গ্রাহকের অর্থ জমার কোনো কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় এমন বিপুল অর্থ আত্মসাৎ সহজ হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ঘটনার পর ভুক্তভোগীরা সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ জানিয়ে জানান, “আমরা ভেবেছিলাম বড় কোম্পানি, তাই বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু এখন টাকার সঙ্গে আমাদের স্বপ্নটাও হারিয়ে গেছে।”
সাবাস বাংলাদেশ অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটি একাধিক মিডিয়া ও সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে প্রচুর বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহক আকর্ষণ করত। অথচ কোম্পানির প্রকৃত আর্থিক অবস্থা এবং দায়দায়িত্বের কোনো স্বচ্ছতা ছিল না।
এই ঘটনায় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অপরাধ বিভাগ এবং সাইবার ইউনিটের তদন্তও শুরু হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, প্রয়োজন হলে ইন্টারপোল সহযোগিতায় বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এমডি সালমান বিন রশিদকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াও শুরু করা হবে।