ইংরেজি Unemployment শব্দটি থেকে বেকারত্ব শব্দটি এসেছে। বেকারত্ব বলতে এমন এক পরিস্থিতিকে বোঝায় যেখানে একজন ব্যক্তি শারীরিক ও মানসিকভাবে কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কোনো চাকরি খুঁজে পায় না।
এটি শুধুই কর্মসংস্থানের অভাব নয়। এটি একধরনের সামগ্রিক অসামঞ্জস্যতা, যার কারণে মানুষের দক্ষতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যথাযথ কাজে লাগানো সম্ভব হয় না।
অর্থনীতিবিদরা একে জাতির মানবসম্পদের অপচয় হিসেবে দেখেন।
বেকারত্ব ব্যক্তি ও সমাজের জন্য গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন আত্মসম্মানহানি, সামাজিক অস্থিরতা এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি করা ইত্যাদি ।
আবার কেউ কেউ ঠিকই চাকরি করছেন তবে চাকরিটা তার যোগ্যতার তুলনায় নগণ্য—যাকে বলে আংশিক কর্মসংস্থান বা লুকানো বেকারত্ব।
ফলে প্রকৃত ও লুকানো মিলিয়ে বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারত্বের মাত্রা ও সংখ্যা অনেক বেশি।
বেকারত্ব বিশ্বব্যাপী একটি সাধারণ সমস্যা, তবে এর প্রকৃতি ও মাত্রা দেশ ও পরিবেশ ভেদে ভিন্ন রূপে দেখা যায়।
উন্নত দেশগুলোতে—যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি কিংবা জাপানে—বেকারত্ব সাধারণত প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, অর্থনৈতিক মন্দা বা বাজারে চাহিদার পরিবর্তনের ফলে হয়।
তবে এসব দেশে চাকরি হারালে কর্মীদের জন্য সরকারি সহায়তা ও পুনঃপ্রশিক্ষণ ব্যবস্থাও ভালোভাবে গড়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) মতে, ২০২৪ সালে বিশ্বে বেকারের সংখ্যা ২০ কোটিরও বেশি ছিল।
এই সংখ্যার বাইরেও রয়েছে আরও কোটি কোটি মানুষ যারা কাজ করছেন বটে, কিন্তু নিরাপত্তাহীন, কম মজুরির বা অনানুষ্ঠানিক চাকরিতে আছেন।
প্রযুক্তির অগ্রগতি, অটোমেশন এবং গিগ ইকোনমির উত্থানে বিশ্বজুড়ে কর্মসংস্থানের ধরন বদলে যাচ্ছে।
এতে যেমন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি অনেক প্রচলিত পেশাও বিলুপ্ত হচ্ছে।
উন্নত দেশগুলো এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারলেও, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো পিছিয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশে বেকারত্ব একটি গভীর সমস্যা, বিশেষ করে তরুণ সমাজের জন্য।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ নতুন চাকরিপ্রার্থী বাজারে প্রবেশ করলেও তাদের জন্য পর্যাপ্ত চাকরি সৃষ্টি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় ২৭ লাখ মানুষ বেকার ছিল।
তবে এই পরিসংখ্যানে লুকানো বেকারত্ব, আংশিক কর্মসংস্থান এবং অনানুষ্ঠানিক চাকরিতে থাকা লোকজনকে ধরা হয় না। বাস্তবে চিত্রটি আরও জটিল:
সরকারিভাবে বেকারত্বের হার ৫.৩% বলা হলেও, বাস্তব অবস্থা আরো বেশি আশঙ্কাজনক।
বেকারত্ব মানসিক চাপ, সামাজিক বৈষম্য, অপরাধ প্রবণতা এবং তরুণদের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও, দেশের অনেক দক্ষ তরুণ বিদেশে চলে যাচ্ছে, যাকে বলা হয় “ব্রেইন ড্রেইন”।
এটি ভবিষ্যতে দেশের জন্য এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়ন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে কর্মসংস্থানের এই সংকট এখনই সমাধান করতে হবে।
তরুণদের শুধু চাকরি খুঁজতে নয়, উদ্যোক্তা হতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
এবং একটি কর্মক্ষম, উদ্ভাবনী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ে তোলার মাধ্যমেই এই সমস্যা সমাধান সম্ভব।
আরও পড়ুনঃ
সরকারি চাকরি কেন করবেন – কয়েকটি আকর্ষণীয় দিক ও টিপস
প্রাথমিকে ১০ম গ্রেড প্রত্যাশী সহকারী শিক্ষকদের হতাশা বাড়লো
একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, শিল্পের গতি এবং শ্রমবাজারের চাহিদার উপর নির্ভর করে বেকারত্ব বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।
প্রতিটি ধরনের বেকারত্বের আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে এবং এর প্রতিকারেও আলাদা উপায় অবলম্বন করা হয়।
কাঠামোগত বেকারত্ব তখন ঘটে যখন একটি দেশের অর্থনীতি পরিবর্তিত হয় কিন্তু শ্রমিকরা সেই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিজের দক্ষতার পরিবর্তন ও উন্নয়ন করতে না পারলে।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে যদি অটোমেশন প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার হতে থাকে।
আর ঐতিহ্যগত গার্মেন্টস কর্মীরা যদি তাদের দক্ষতা উন্নয়ন না করেন, তবে তারা কাজ হারাবেন এবং বেকার হয়ে যাবেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক শিল্পের অটোমেশন বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে কিছু কাজ হারিয়ে যাচ্ছে।
এর ফলে শ্রমিকদেরকে পুনঃপ্রশিক্ষণ বা নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগ প্রদান অত্যন্ত জরুরি, যাতে তারা নতুন বাজারের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
ফ্রিকশনাল বেকারত্ব স্বাভাবিক ও স্বল্প স্থায়ী একটি প্রক্রিয়া। এটি তখনই হয় যখন কেউ চাকরি পরিবর্তন করেন বা নতুন স্নাতকরা প্রথম চাকরি খুঁজেন।
এই ধরনের বেকারত্ব অস্থায়ী এবং সাধারণত কিছুদিনের মধ্যে সমাধান হয়ে যায়।
বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে অনেকেই প্রথম চাকরি খুঁজে পেতে কিছু সময় বেকার অবস্থায় থাকেন।
তাদের জন্য ক্যারিয়ার গাইডেন্স এবং দ্রুত চাকরি খোঁজার প্ল্যাটফর্মের উন্নতি করা যেতে পারে, যাতে তারা দ্রুত তাদের পছন্দসই চাকুরী খুঁজে পেতে পারে।
চক্রগত বেকারত্ব অর্থনৈতিক মন্দা বা ব্যবসায়িক চক্রের সময় ঘটে।
যখন কারখানার উৎপাদন কমে যায় তখন কর্মসংস্থানে জনবলের প্রয়োজনীয়তা কমে যায় ফলস্বরূপ কর্মী ছাঁটাই করার প্রয়োজন হয়।
উদাহরণস্বরূপ, করোনাভাইরাস মহামারী বাংলাদেশের পর্যটন, উৎপাদন এবং খুচরা খাতকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, যার ফলে বহু কর্মী ছাঁটাই হয়েছিল।
এই ধরনের বেকারত্ব সাধারণত সাময়িক হয় এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হলে এটি কমে যায়।
তবে, এটি মোকাবেলা করার জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সহায়ক নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
মৌসুমি বেকারত্ব এমন বেকারত্ব যা বিশেষভাবে কৃষি বা পর্যটন শিল্পে ঘটে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন ধানকাটা শ্রমিক শুধুমাত্র ধান বোনা ও কাটার সময় কাজ করেন, তার অন্যান্য সময় কাজ থাকে না।
বাংলাদেশে কৃষি খাতে মৌসুমি বেকারত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। শ্রমিকরা বিশেষ মৌসুমে কাজের সুযোগ পান, কিন্তু বাকি সময় তাদের জন্য কোনো কাজ থাকে না।
এই সমস্যা সমাধান করতে হলে, কৃষিখাতে স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং পর্যটন শিল্পে কর্মরতদের বছরের বিভিন্ন সময়ে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
লুকানো বেকারত্ব বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় বেশি দেখা যায়। যে কাজ অল্প ব্যাক্তি সম্পন্ন করতে পারবেন ।
সেই একই কাজ একাধিক ব্যক্তি সম্পন্ন করছেন হলেন ফলে যে পরিমাণ পারিশ্রমিক অল্প শ্রমিক বেশি হারে পেতেন।
সেই একই পরিমাণে পারিশ্রমিক অনেক জনের মধ্যে বন্টন হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, এক গ্রামের ধানকাটা কাজে ৫ জন শ্রমিক কাজ করছেন, কিন্তু তারা ২ জনেই সেই কাজ শেষ করতে পারতেন।
তবে বাংলাদেশের আইনে এই অতিরিক্ত শ্রমিকদের বেকার হিসেবে গণনা করা হয় না, কিন্তু তারা আসলে কার্যকরভাবে কাজ করছে না, ফলে উৎপাদনশীলতা কমে যায়।
এই ধরনের বেকারত্ব দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদন কমিয়ে দেয় এবং এটি সরকারী পরিসংখ্যানের মধ্যে ধরা পড়ে না।
এটি মোকাবেলা করতে, গ্রামীণ অর্থনীতির আধুনিকীকরণ, কৃষিতে যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা জরুরি।
বাংলাদেশে বেকারত্বের সমস্যা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে, এবং এর পেছনে একাধিক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণ রয়েছে।
দেশের শ্রমবাজারের বৈচিত্র্য ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বেকারত্ব সমস্যার মূল কারণ ও সমাধান খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরী।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ কর্মক্ষম যুবক-যুবতী শ্রমবাজারে প্রবেশ করে।
তবে দেশের অর্থনীতি এই বিপুল পরিমাণ জন শক্তির জন্য পর্যাপ্ত নতুন চাকরি সৃষ্টি করতে পারছে না।
এটি একটি মারাত্মক সমস্যা, যেভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে শ্রমবাজারের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা একে অপরকে ত্বরান্বিত করছে।
বর্তমানে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭০ মিলিয়নেরও বেশি, এবং এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশই কর্মক্ষম জনগণ।
কিন্তু শিল্প, প্রযুক্তি এবং অন্যান্য খাতের প্রসারণের হার তাদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না।
যদি এই বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না হয়, তবে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাবে এবং যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
এটি কাটিয়ে উঠতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রে সহায়ক নীতি প্রণয়ন করা জরুরি।
বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে তৈরি পোশাক (RMG) হলো অন্যতম সফল শিল্প খাত।
কিন্তু অন্যান্য শিল্প যেমন ইলেকট্রনিক্স, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং ভারী প্রকৌশল শিল্পে যথেষ্ট উন্নতি হয়নি।
ফলে, বাংলাদেশে শ্রমবাজারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার জন্য শিল্প খাতের বৈচিত্র্য নেই।
নতুন শিল্প খাতগুলোর সঠিকভাবে বিকাশ না হওয়ায়, অর্থনীতির গতি ধীর হয়ে পড়ছে এবং সাধারণত গ্রামীণ ও তরুণ জনগণের জন্য পর্যাপ্ত চাকরির ক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে না।
এর ফলে শ্রমিকদের জন্য কাজের সুযোগ সীমিত থাকছে, যা নতুনদের কর্মসংস্থান খুঁজে পাওয়া আরও কঠিন করে তুলছে।
বাংলাদেশে শিল্পায়ন বাড়ানোর জন্য সরকারের উচিত শিল্প খাতের জন্য নতুন পলিসি তৈরি করা এবং বিদেশী বিনিয়োগকে আকর্ষিত করা, পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোগগুলোকে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।
আরও পড়ুনঃ
নন ক্যাডার পদে বড় আকারে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বিপিএসসি
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাজারের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না।
অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা লাভ করলেও তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সফট স্কিল, ডিজিটাল দক্ষতা বা বাজারের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, সমাজবিজ্ঞানের স্নাতকদের মধ্যে অনেকেই ডিজিটাল মার্কেটিং বা কোডিংয়ের মতো প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই যার কারণে তারা চাকরি বাজারে সফল হতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
এছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিজিটাল শিক্ষা এবং বাস্তব জীবনের কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।
ফলে, ছাত্ররা পেশাদার জীবনে প্রবেশ করার পূর্বে নতুন করে তাদের দক্ষতা অর্জন করতে হচ্ছে, যা তাদের চাকরি খোঁজার প্রক্রিয়া দীর্ঘতর করে বেকারত্ব বৃদ্ধি করছে।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠ্যক্রমে দক্ষতার ভিত্তিতে শিক্ষা প্রদান এবং কর্মশক্তির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত, যাতে নতুন স্নাতকেরা বাজারে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত থাকে।
গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) যথেষ্ট বিনিয়োগের অভাব বাংলাদেশে নতুন শিল্প ও প্রযুক্তি খাতের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে।
উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ কোরিয়া তাদের অর্থনীতিকে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটিয়ে উন্নত করেছে, তবে বাংলাদেশে এই ধরনের উদ্যোগ এখনো পর্যাপ্তভাবে বিকশিত হয়নি।
যেহেতু বাংলাদেশে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন বা নতুন শিল্পের বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা হচ্ছে না, তাই দেশের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ সীমিত।
এভাবে, রপ্তানি খাতের একপেশে নির্ভরতা বাংলাদেশের বেকারত্ব সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
এটি সমাধান করতে, সরকারকে গবেষণা এবং উদ্ভাবন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত।
দেশের নতুন প্রযুক্তির খাতকে উৎসাহিত করতে পারদর্শী উদ্যোক্তা এবং গবেষকদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।
বাংলাদেশের প্রায় ৩৮% শ্রমিক কৃষি খাতে কাজ করে, কিন্তু এই খাত মোট জাতীয় উৎপাদনে (GDP) মাত্র ১৫% অবদান রাখে।
কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের অভাব এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার না হওয়ায় উৎপাদনশীলতা কম।
যার ফলে স্বল্প পরিমাণ কাজের জন্য অধিক সংখ্যক শ্রমিককে মাঠে কাজ করতে হচ্ছে ।
এটি কাটিয়ে উঠতে, কৃষির আধুনিকীকরণ, যান্ত্রিকীকরণ এবং সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের জন্য স্থায়ী কর্মসংস্থান তৈরি করা যেতে পারে।
এছাড়া, অন্য খাতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য উৎপাদন খাতে বৈচিত্র্য আনা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি একটি বড় বাধা।
অনেক সময় দক্ষ এবং যোগ্য প্রার্থীকে চাকরির সুযোগ দেয়া হয় না, বরং রাজনৈতিক বা আর্থিক প্রভাবের মাধ্যমে অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হয়।
এই দুর্নীতির কারণে, প্রকৃত মেধাবীরা চাকরি পায় না এবং দেশের শ্রমবাজারের দক্ষতা কমে যায়।
এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে, সরকারকে সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশে নারীরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বাধা, পরিবহন সমস্যা, শিশু পালন ইত্যাদি কারণে শ্রমবাজারে পূর্ণাঙ্গভাবে অংশ নিতে পারেন না।
এছাড়া, নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও সহানুভূতির অভাব, যেমন ধর্ষণ বা হেনস্তার শিকার হওয়ার আশঙ্কা, তাদের কাজের সুযোগ সীমিত করে দেয়।
এর ফলে, দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা অর্থনৈতিকভাবে অবদান রাখতে সক্ষম হলেও তারা কার্যকরভাবে অর্থনীতির অংশ হতে পারে না।
এটি সমাধান করতে, সরকার এবং বেসরকারী খাতকে নারীদের জন্য কর্মস্থলে নিরাপত্তা, সুবিধা এবং সহানুভূতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে তারা পূর্ণাঙ্গভাবে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করতে পারে।
বেকারত্ব কেবল একটি শ্রমবাজারে নয়, এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ব্যক্তির মানসিক স্তরে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
বেকারত্বের ফলে যেমন ব্যক্তি এবং পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি বৃহত্তর অর্থনীতিতেও তার দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বেকারত্বের সবচেয়ে সরাসরি প্রভাব হলো অর্থনৈতিক স্থবিরতা।
যখন মানুষ চাকরি হারায় বা নতুন চাকরি খুঁজে পায় না, তখন তাদের আয় কমে যায়, যার ফলে তাদের খরচ করার ক্ষমতাও হ্রাস পায়।
ফলস্বরূপ, দেশে ভোক্তা ব্যয় কমে যায়, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধীর করে দেয়।
প্রতিটি কর্মক্ষম মানুষের উপার্জন বা আয় দেশের মোট জাতীয় আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কাজ করে।
যখন একটি বড় অংশ বেকার হয়ে পড়ে তখন ক্রেতার সংখ্যা ও চাহিদা হ্রাস পায় এবং উৎপাদন কমে যায়।
এটি ব্যবসায়ের বিক্রয় কমিয়ে দেয়, প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের সুযোগ হারায় এবং নতুন চাকরি সৃষ্টির সুযোগ কমে যায়।
এটি একটি নেতিবাচক চক্র তৈরি করে, যার ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।
অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য, সরকারকে বেকারত্ব হ্রাসে কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে, যেমন নতুন শিল্প ও সেবার খাত তৈরি করা, পুরোনো খাতের আধুনিকীকরণ, এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার উন্নয়ন।
বেকারত্বের আরেকটি মারাত্মক প্রভাব হলো অপরাধ এবং সামাজিক অস্থিরতার বৃদ্ধি।
চাকরি হারানো বা দীর্ঘ সময় ধরে বেকার থাকা মানুষের মধ্যে হতাশা এবং হতাশার সৃষ্টি হতে পারে, যা তাদের অপরাধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করতে পারে।
একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে “Idle hands are the devil’s workshop”
এমনকি যে ব্যক্তি কাজ না পেয়ে সামাজিক চাপের শিকার হন, তখন তার মধ্যে চুরি, প্রতারণার এমনকি সহিংস অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
শহুরে বস্তি এবং গ্রামীণ অঞ্চলে বেকার যুবকরা অধিকাংশ সময় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
বেকার যুবকরা যখন তাদের অভাব পূরণের জন্য কাজ না পেয়ে বিকল্প পথ বেছে নেয়, তখন সে অপরাধ প্রবণতা তৈরি হয়।
বিশেষ করে নগর অঞ্চলে, যেখানে ধনী-গরিবের বৈষম্য স্পষ্ট, সেখানে অপরাধের ঘটনা অনেক বেশি ঘটে।
এটি সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে, যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর চাপ সৃষ্টি করে।
এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে, সরকারের উচিত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি করা, যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং তাদের জন্য দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করা।
বেকারত্ব মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার একটি বড় কারণ হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে বেকার থাকার ফলে এক ধরনের হতাশা, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতা সৃষ্টি হতে পারে।
বিশেষত শহুরে যুবকদের মধ্যে এই সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
যখন চাকরি নেই, তখন জীবনযাত্রার মান কমে যায় এবং ব্যক্তি তাদের আত্মসম্মান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
অনেক সময়, মানসিক চাপের ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
যখন ব্যক্তি জানে যে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বা দক্ষতার যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না, তখন তার মানসিক চাপ আরও বেড়ে যায়।
শহুরে তরুণরা এই ধরনের হতাশার শিকার হয়, কারণ তারা তাদের শিক্ষাগত অর্জন বা দক্ষতার কারণে চাকরি না পাওয়ার হতাশা অনুভব করে।
এই ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলা করতে, সরকারের উচিত কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো এবং সেইসাথে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সহায়ক নীতি গ্রহণ করা, যাতে ব্যক্তি তাদের সমস্যাগুলি সহায়তার মাধ্যমে সমাধান করতে পারে।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত এবং দক্ষ যুবকদের জন্য একটি বড় সমস্যা হলো দেশ থেকে মেধাবীদের অভিবাসন বা “Brain Drain”।
বেকারত্বের কারণে, বাংলাদেশে অনেক তরুণ তাদের মেধা এবং দক্ষতার সদ্ব্যবহার করতে পারেন না, এবং তারা বিদেশে উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগের জন্য চলে যান।
এটি চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, আইটি পেশাদারদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায়। যারা বিদেশে অধিক আয় এবং উন্নত কর্মপরিবেশের জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান।
“Brain Drain” বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী বিপদ, কারণ এটির মাধ্যমে দেশের উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং উন্নয়নশীল খাতগুলির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদকে হারিয়ে ফেলে।
যখন অভিজ্ঞ পেশাদাররা দেশ ছেড়ে চলে যান, তখন তাদের দক্ষতা এবং জ্ঞানের অভাব দেশের উন্নয়নকে সীমাবদ্ধ করে দেয়।
এটি সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, কারণ তারা যদি প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান এবং সুযোগ না দেয়, তবে মেধাবী যুবকরা অন্য দেশে কর্মসংস্থান খোঁজার জন্য উদ্বুদ্ধ হবে।
এই সমস্যা সমাধান করতে, সরকারকে তরুণদের জন্য উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে এবং প্রযুক্তি, শিক্ষা, এবং উদ্ভাবন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বেকারত্ব কমানোর জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এসব উদ্যোগের মধ্যদিয়ে বেকার যুবকদের জন্য চাকরি তৈরি করতে সাহায্য করার পাশাপাশি তাদের দক্ষতা ও সামর্থ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কিন্তু এইসব উদ্যেগ বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য যথেষ্ট নয়।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (ADB) এর সহযোগিতায় পরিচালিত দক্ষতা ভিত্তিক কর্মসংস্থান বিনিয়োগ প্রোগ্রাম (SEIP) বাংলাদেশের ২০০,০০০ এরও বেশি যুবককে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত দক্ষতা শেখার সুযোগ দিয়েছে।
এই প্রোগ্রামের আওতায় যুবকরা প্লাম্বিং, গ্রাফিক ডিজাইন, ইলেকট্রিক্যাল কাজ এবং আরও অনেক পেশায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
এই প্রশিক্ষণগুলি তাদের চাকরি পেতে সহায়ক হচ্ছে এবং তারা তাদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠুভাবে আয় করতে পারছেন।
SEIP-এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা দক্ষতা অর্জন করে নিজেদের চাকরির সুযোগ তৈরি করছে।
এই উদ্যোগ চাকরি পাওয়ার হার বাড়াচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
জাতীয় সেবা কর্মসূচি বাংলাদেশের শিক্ষিত যুবকদের জন্য সরকারী চাকরির সুযোগ তৈরি করে, যদিও এটি একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা।
এই কর্মসূচির মাধ্যমে, সরকারি দপ্তরগুলোতে তরুণদের কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়, যাতে তারা কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।
কিন্তু এই উদ্যোগও দীর্ঘমেয়াদী চাকরি সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়, তবে এটি আর্থিক সহায়তা ও অভিজ্ঞতা প্রদান করে।
এই কর্মসূচির মাধ্যমে, তরুণরা তাদের কর্মজীবনের শুরুতেই অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে, যা ভবিষ্যতে তাদের জন্য আরও ভালো চাকরির সুযোগ তৈরি করে।
এটি সরকারের তরফ থেকে একটি সহায়ক পদক্ষেপ, যা যুবকদের স্বল্পমেয়াদী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করছে ও বেকারত্ব কমাতে ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বিভিন্ন ধরনের ফ্রি এবং সাবসিডি প্রাপ্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যার মাধ্যমে যুবকরা ৩৬টি পেশায় দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন।
এই প্রশিক্ষণগুলির মধ্যে গ্রাফিক ডিজাইন, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এবং কৃষি প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তবে, এই প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামগুলির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রেই, প্রশিক্ষণের অবস্থান সীমিত এবং পুরনো পাঠ্যক্রম ব্যবহৃত হয়, যা বর্তমান বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারে না।
যদি এই প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামগুলিকে আরও আধুনিক এবং বিস্তৃত করা যায়, তবে তা যুবকদের জন্য আরও কার্যকরী হতে পারে এবং তাদের কর্মসংস্থানে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের আইসিটি বিভাগ এর অধীনে শুরু হওয়া স্টার্ট-আপ বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রাম, যা তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়ন, পরামর্শ এবং সম্পদ সরবরাহ করে।
এই প্রোগ্রামটি নতুন ব্যবসায়িক ধারণা প্রতিষ্ঠা এবং ছোট ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।
স্টার্ট-আপ বাংলাদেশ উদ্যোক্তাদের নতুন ব্যবসা শুরু করতে প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্ট সংস্থান ও গাইডলাইন প্রদান করে।
যা তাদের ব্যবসা গড়ে তোলার পথ সুগম করে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে, নতুন উদ্যোক্তা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং দেশব্যাপী বেকারত্ব কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
এছাড়া, স্টার্ট-আপগুলির জন্য নেটওয়ার্কিং সুযোগ সৃষ্টি করা হয়, যা তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগী এবং বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সহায়ক।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে, তরুণরা তাদের নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হচ্ছে, যা কর্মসংস্থান তৈরি করছে এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।
শিক্ষা সংস্কার বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।
একটি উন্নত কর্মসংস্থানের বাজার গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার্থীদের এমন দক্ষতা অর্জন করতে হবে যা বর্তমান এবং ভবিষ্যতের বাজারের চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে বেশ কিছু ঘাটতি রয়েছে যা দ্রুত সমাধান করা জরুরি।
বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত পাঠ্যবই নির্ভর এবং সৃজনশীল চিন্তা, যোগাযোগ দক্ষতা বা সামাজিক দক্ষতা অর্জন করার জন্য খুব বেশি সুযোগ তৈরি করে না।
অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের পদ্ধতি গৎবাঁধা, যেখানে থিওরি শেখানোর প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়া হয় এবং সৃজনশীলতার ওপর জোর কম।
কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় সফল হতে হলে একজন ব্যক্তি কেবলমাত্র তথ্যে দক্ষ হতে পারে না; তাকে বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করতে, নতুন ধারণা তৈরি করতে এবং কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে শিখতে হবে।
এটি শুধু শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানে সীমাবদ্ধ রেখে দিচ্ছে, বরং তাদেরকে জীবনের বাস্তব চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য প্রস্তুত করছে না।
উদাহরণস্বরূপ, এনালিটিক্যাল স্কিল, ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং, এবং কর্মক্ষেত্রে যোগাযোগের দক্ষতা—এইসব বিষয়ের উপর পাঠ্যক্রমে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
যা আমাদের শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত করবে।
বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো বৃত্তিমূলক এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষা (TVET) এর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া।
আমাদের দেশে Polytechnic ইনস্টিটিউটগুলো এবং TVET কেন্দ্রগুলো এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে বিস্তৃত নয়, এবং অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিকতার অভাব রয়েছে।
বর্তমানে দক্ষ কর্মী তৈরির জন্য ইলেকট্রিক্যাল, কনস্ট্রাকশন, গ্রাফিক ডিজাইন, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এবং মেকানিকাল টেকনোলজি এর মতো ক্ষেত্রগুলোতে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।
TVET প্রতিষ্ঠানগুলোর আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অর্জন করা যাবে।
এতে যুবকরা সঠিক দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। ফলে এটি তাদের কর্মসংস্থান খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
বর্তমান যুগে, ডিজিটাল দক্ষতা (Digital Literacy) এখন মৌলিক সাক্ষরতা হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে।
মাইক্রোসফট অফিস, কোডিং, ওয়েব ডিজাইন এবং ডিজিটাল মার্কেটিং—এইসব দক্ষতা যুবকদের আজকের বাজারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এসব দক্ষতা ছাড়া, একজন ব্যক্তি প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ডিজিটাল দক্ষতার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ খুব কম প্রদান করা হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিজিটাল শিক্ষা এবং প্রযুক্তির উপর আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
যাতে শিক্ষার্থীরা কেবল ক্লাসরুমে নয়, বরং অনলাইন ও টেকনিক্যাল দুনিয়াতেও দক্ষ হয়ে উঠতে পারে।
এটি ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানে তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হিসেবে কাজ করবে।
বেকারত্ব মোকাবেলায় উদ্যোক্তা হওয়া একটি শক্তিশালী সমাধান হতে পারে।
উদ্যোক্তারা শুধুমাত্র নিজেদের চাকরি তৈরি করেন না, তারা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
তবে, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য শুধু ধারণা থাকা নয়, সেই ধারণাকে বাস্তবায়নের জন্য প্রযুক্তি, আর্থিক সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
যুবকদের সমস্যা সমাধান এবং উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা শেখানোর দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায়, ছাত্রদের প্রায়শই শিক্ষকদের দেয়া সিলেবাস অনুযায়ী পড়াশোনা করতে বলা হয়।
কিন্তু বাস্তব জীবনে সফল হওয়ার জন্য তাদেরকে নতুন ধারণা সৃষ্টি, প্রোটোটাইপ তৈরি, এবং আইডিয়া উপস্থাপন করতে শিখতে হবে।
স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উদ্ভাবনী কেন্দ্র (Incubation Hubs) এবং মেকার স্পেস স্থাপন করার দিকে মনোযোগী হতে হবে।
যেখানে ছাত্ররা তাদের চিন্তা-ভাবনা বাস্তবায়ন করতে পারে এবং নতুন উদ্যোগ ও ধারণা তৈরি করতে পারে। এটি তাদেরকে উদ্যোক্তা হিসেবেও আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে।
বাংলাদেশে ছোট ব্যবসা শুরু করা এবং সম্প্রসারণের জন্য মাইক্রোফাইন্যান্স এবং SME ঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কিন্তু অনেক সময় ঋণ প্রক্রিয়া জটিল এবং উচ্চ সুদের কারণে ছোট উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে বিরত থাকেন।
ব্যাংকগুলোকে এই ঋণ প্রক্রিয়াকে আরও সহজ এবং দ্রুত করতে হবে এবং সুদের হার কমাতে হবে যাতে ছোট ব্যবসায়ীরা সহজেই ঋণ নিতে পারেন এবং তাদের ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
এটি উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরি করতে সাহায্য করবে এবং দেশজুড়ে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
গ্রামীণ নারীরা বর্তমানে ব্যবসা পরিচালনা করে এবং তাদের নিজস্ব উদ্যোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।
যেমন, বুটিক শপ, ছোট খাটো কৃষি উদ্যোগ ইত্যাদি। তবে, তারা মূলধন, বাজার এবং নেটওয়ার্কিং এর অভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নারীদের জন্য ঋণ সুবিধা, প্রশিক্ষণ, এবং মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম প্রদান করতে হবে।
এতে করে গ্রামীণ নারীরা তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে সক্ষম হবে এবং তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
বেসরকারি খাত, বা প্রাইভেট সেক্টর, দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিভিন্ন কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠান তাদের কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (CSR) এর মাধ্যমে বেকারত্ব কমানোর জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত চাকরি প্ল্যাটফর্ম যেমন Chakri.com বা Bdjobs.com-এ উন্নত এআই (AI)-ভিত্তিক ম্যাচমেকিং সিস্টেম চালু করা।
এতে করে চাকরি প্রার্থীরা তাদের দক্ষতার সাথে সঠিক কাজ খুঁজে পাবে এবং দূরবর্তী কাজের সুযোগ এবং গ্রামীণ এলাকার outreach বাড়ানো যাবে।
এটি দেশের গ্রামীণ এলাকায় চাকরি পেতে সহজ করবে।
CSR কর্মসূচি শুধুমাত্র গাছ লাগানোর মতো কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়।
কোম্পানিগুলো তাদের CSR উদ্যোগের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ফেলোশিপ প্রদান করতে পারে এবং স্টার্টআপদের মেন্টরিং করতে পারে, যা উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক হবে।
প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে ম্যান্ডেটরি (অবশ্যই) পেইড ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে, যা ছাত্রদের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়ক হবে।
এভাবে, ইন্টার্নরা তাদের প্রথম চাকরি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হবে এবং তরুণরা কাজের জন্য দ্রুত প্রস্তুত হয়ে উঠবে।
প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল অর্থনীতি বর্তমানে বিশ্বের কর্মসংস্থান বাজারে এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসছে।
বাংলাদেশও এই পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন নতুন চাকরি সৃষ্টি হচ্ছে।
ডিজিটাল কাজের ক্ষেত্র যেমন ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স, এআই এবং অটোমেশন দেশের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
আসুন, এই দিকগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করি।
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ২৯ তম অনলাইন শ্রমিক সরবরাহকারী দেশ। যদিও কিছু বছর পূর্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল।
ফ্রিল্যান্সিং এবং রিমোট কাজের ক্ষেত্রটি বাংলাদেশে আশাব্যঞ্জকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষ করে গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, এসইও (SEO), ডিজিটাল মার্কেটিং, এবং কনটেন্ট রাইটিং এর মতো দক্ষতার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশে অনেক তরুণ-তরুণী এখন ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে বৈশ্বিক বাজারে তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করে কাজ করছেন এবং অনেকেরই একটি সফল ক্যারিয়ার গড়ে উঠেছে।
Upwork, Freelancer, Fiverr, এবং Toptal এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলিতে কাস্টমার সার্ভিস, এপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং, এবং আরও অনেক ধরনের দক্ষতা নিয়ে কাজ করা যাচ্ছে।
রিমোট কাজের সুযোগ বাংলাদেশে বাড়ানোর জন্য সরকারের উদ্যোগ যেমন উদ্যোক্তা মেন্টরশিপ, ফ্রিল্যান্সিং কোর্স এবং টেকনিক্যাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এইসব কর্মসূচি তরুণদেরকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক দক্ষতা অর্জন করতে সাহায্য করবে।
এগুলোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা সহজে দেশে আনার জন্য পেপাল বাংলাদেশের চালু করা অতীব জরুরী।
বর্তমানে বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত দ্রুত বাড়ছে। D
araz, Pickaboo, PriyoShop এবং অন্যান্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো অনলাইন শপিং এর মাধ্যমে দেশের ভোক্তাদের কাছে পণ্য পৌঁছানোর পাশাপাশি বিভিন্ন নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করছে।
এদের মাধ্যমে লজিস্টিকস, আইটি সাপোর্ট, মার্কেটিং, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট এবং গ্রাহক সেবা ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে।
এই প্ল্যাটফর্মগুলো একদিকে যেমন গ্রাহকদের জন্য সুবিধা এনে দিচ্ছে, তেমনি নতুন স্টার্টআপস এবং উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করছে।
ছোট ব্যবসাগুলো এখন সহজেই তাদের পণ্য বা সেবা অনলাইনে বিক্রি করতে পারছে এবং এতে তারা সারা দেশে ভোক্তা অর্জন করছে।
সরকার যদি ই-কমার্সের জন্য একটি সহজ নিবন্ধন প্রক্রিয়া, নতুন উদ্যোক্তা সহায়তা এবং ই-কমার্স ট্যাক্স পলিসি তৈরি করে, তবে এটি অনলাইন ব্যবসা এবং নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে।
প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এবং অটোমেশন এখন কর্মসংস্থান বাজারে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
যেমন, এআই এথিক্স কনসালট্যান্ট, ডেটা লেবেলার, মেশিন লার্নিং ট্রেইনার এবং এআই টেকনোলজি প্রফেশনাল এইসব নতুন চাকরির উত্থান হচ্ছে।
দেশীয় শিল্পগুলোকে যদি এআই ইনস্টলেশন, ডেটা অ্যানালাইসিস, এবং অটোমেশন প্রযুক্তি উন্নত করতে উৎসাহিত করা যায়, তবে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করবে।
এআই এবং অটোমেশন প্রযুক্তি নিয়ে দক্ষ কর্মী তৈরি করতে ট্রেনিং কোর্স এবং ইনোভেশন হাব গড়ে তুলতে হবে, যা শ্রমশক্তিকে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে সহায়ক করবে এবং কর্মসংস্থান বাজারের আমূল পরিবর্তন আনবে।
বিশ্বব্যাপী সবুজ অর্থনীতি, পরিবেশবান্ধব শিল্প এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।
এর মধ্যে সবুজ চাকরি বা এনার্জি সেক্টর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি পরিবেশ সংরক্ষণ এবং শ্রমিকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে সহায়ক।
বাংলাদেশও এই খাতে তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।
পুনঃব্যবহারযোগ্য আবর্জনা, জল পরিশোধন, ইকো-ফ্রেন্ডলি প্যাকেজিং—এই পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলোতে বিশেষ দক্ষ কর্মী প্রয়োজন।
পরিবেশবান্ধব শিল্প সেক্টর বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাংলাদেশে এর মধ্যে একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এই খাতে কাজের জন্য পরিবেশ বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, এবং ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞদের চাহিদা বাড়ছে।
সরকার যদি সবুজ প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ সম্পর্কে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলোকে সচেতন করে, তবে এটি নতুন চাকরি এবং স্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ বা সোলার সিস্টেম এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে । সোলার প্যানেল ইনস্টলার এবং মেন্টেনেন্স এক্সপার্ট এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শহর ও গ্রামে সোলার শক্তির ব্যবহার বেড়ে চলেছে এবং এই খাতে দক্ষ কর্মী তৈরি করতে আরো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং বৃত্তিমূলক কোর্স দরকার।
এটি দেশের উন্নয়ন এবং শক্তি নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশের শহুরে কৃষি বা অ্যাগ্রো-টেক খাতে একটি নতুন বিপ্লব আসছে।
ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং, আক্যাপনিক্স, এবং ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) ভিত্তিক স্মার্ট ফার্মিং এর মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এতে প্রচুর নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে।
শহরের ভেতরে কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা যাচ্ছে, যা হাজার হাজার লোকের জন্য চাকরি সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশে বেকারত্ব সমস্যা একটি জটিল চ্যালেঞ্জ। তবে, সঠিক পরিকল্পনা, নীতিগত ধারাবাহিকতা, এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব।
ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান বাজারের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং কৌশল তুলে ধরা হলো।
এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে বেকারত্ব দূরীকরণের পথে বাংলাদেশ সবার জন্য একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে।
বেকারত্ব সমস্যা দূরীকরণে সরকারি উদ্যোগগুলি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোর ধারাবাহিকতা ও সদিচ্ছা।
রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা পরিবর্তনের সাথে সাথে নীতির পরিবর্তন দেশের উন্নয়ন প্রকল্পকে প্রভাবিত করতে পারে।
বাংলাদেশের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদী নীতির প্রয়োজন, যা শুধু নির্বাচনী প্রচারনার অংশ না হয়ে, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
অতএব, সরকারের কর্মসংস্থান সম্পর্কিত নীতি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে বাস্তবায়িত হওয়া উচিত, যাতে এর সুফল আগামী কয়েক দশক ধরে দেশের যুব সমাজ ও অর্থনীতির উন্নতি করতে পারে।
একইভাবে, এই নীতির প্রতি দ্বিদলীয় সমর্থন নিশ্চিত করা দরকার, যা সরকারের পরিবর্তনের সাথে বিপরীত হতে না পারে।
সরকারি এবং বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ, এবং এতে সকল অংশীদারের সম্মিলিত পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ থাকতে হবে।
ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো বৃহত্তর শহরগুলোতে বেকারত্বের চাপ বেড়েই চলেছে, বিশেষ করে শহরের বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে।
তবে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZs) স্থাপন এবং আঞ্চলিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে এই চাপ কিছুটা কমানো সম্ভব।
যেমন, রংপুর, খুলনা, এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে নতুন শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে পারলে, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।
এতে ওই অঞ্চলের যুবক-যুবতীরা নিকটবর্তী এলাকার মধ্যেই কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে, ফলে ঢাকার দিকে মাইগ্রেশন কমে যাবে এবং আঞ্চলিক সমতাবোধ তৈরি হবে।
তাছাড়া, এসব অঞ্চলে কৃষি, শিল্প, এবং পরিষেবা খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, আঞ্চলিক উন্নয়ন সম্ভব।
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (SEZ) অবকাঠামো উন্নয়ন, ইন্টারনেট সংযোগ, এবং প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান করলে এখানকার কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের অর্থনীতি আরো সমৃদ্ধ হবে, বেকারত্ব হ্রাস পাবে।
বাংলাদেশ বর্তমানে শ্রমশক্তির বৃহৎ উৎস, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দক্ষতার রপ্তানি আরও গুরুত্ব পেতে পারে।
যেমন, দক্ষ কর্মী রপ্তানি নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে অন্যান্য উন্নত দেশ যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE), এবং জাপান এর সাথে শ্রম অভিবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে।
এসব দেশগুলোর শ্রমবাজারে বাংলাদেশিরা তাদের দক্ষতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান খুঁজে পাবে।
উদাহরণস্বরূপ, আইটি, মেডিকেল সেক্টর, ইঞ্জিনিয়ারিং, এবং ডিজিটাল মার্কেটিং-এ কর্মী রপ্তানি করা যেতে পারে।
তবে, এজন্য সরকারকে স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং ভিসা পদ্ধতি সহজ করা সহ বিভিন্ন ধরণের সুবিধা দিতে হবে।
তাছাড়া, সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে যৌথভাবে ট্রেনিং প্রোগ্রাম আয়োজন করতে হবে।
যেখানে দেশের কর্মীদের জন্য অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যাতে তারা বিদেশে উচ্চমূল্যে কাজের সুযোগ পায়।
বাংলাদেশে যুবকদের মধ্যে প্রথাগত পেশা বেছে নেওয়ার প্রবণতা খুব বেশি।
তবে, নতুন যুগের উদ্যোক্তা এবং নবীন শিল্পী তৈরি করতে হলে, তাদের মানসিকতায় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।
যুবকদেরকে ঝুঁকি নিতে, দৃঢ়তা এবং অ্যাডাপটেবিলিটি ( পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে সক্ষমতা) শিখাতে হবে।
এক্ষেত্রে, প্রশিক্ষণ এবং মেন্টরশিপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিভিন্ন স্টার্টআপ ইনকিউবেটর এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোকে উদ্যোক্তা তৈরি করার একটি কেন্দ্র হিসেবে তৈরি করা যেতে পারে।
উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হতে হলে, নেটওয়ার্কিং, ফিনান্স ম্যানেজমেন্ট, এবং ক্রিয়েটিভিটি শিখতে হবে, যা প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণত নেই।
তাছাড়া, দেশে স্টার্টআপ হাব এবং ইনোভেশন স্পেস তৈরি করার মাধ্যমে যুবদের উদ্যোক্তা তৈরি করা সম্ভব।
নতুন ধারার পেশা ও ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য এসব প্ল্যাটফর্ম গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, যেখানে যুবরা তাদের প্রারম্ভিক ধারণা নিয়ে কাজ করতে পারবে।
বাংলাদেশের বেকারত্ব কেবল একটি পরিসংখ্যানগত সমস্যা নয়—এটি একটি বহুস্তর, বহু-মাত্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট।
একজন তরুণ চাকরি না পেলে সেটি শুধু তার নয়, পুরো পরিবার, সমাজ এবং দেশের উন্নয়নের গতিপথকে ব্যাহত করে।
বেকারত্ব মানে হচ্ছে মানব সম্পদের, সম্ভাবনার, এবং জাতীয় শক্তির অপচয় ।
এই সমস্যার সমাধান কোনো একক খাতে সীমাবদ্ধ নয়। এটি থেকে মুক্তি পেতে চায় একটি সামগ্রিক, আন্তঃখাত ভিত্তিক নীতিমালা।
যার মধ্যে থাকবে শিক্ষার সংস্কার, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ, ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, উদ্যোক্তা তৈরির নীতিমালা, নারী অন্তর্ভুক্তি, এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা।
শুধু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করলেই চলবে না—সেগুলো হতে হবে মানসম্মত, স্থিতিশীল, এবং সম্মানজনক।
একজন কর্মীর কাজের নিরাপত্তা, ন্যায্য বেতন, স্বাস্থ্যসেবা, এবং উন্নয়নের সুযোগ থাকা উচিত।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তখনই পূর্ণতা পায় যখন তার সুফল সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছায়।
বাংলাদেশের তরুণদের হাতে যদি সঠিক দিকনির্দেশনা, প্রশিক্ষণ এবং পুঁজি থাকে, তাহলে তারা শুধু চাকরি প্রার্থী নয়, বরং চাকরি প্রদানকারী হিসেবেও গড়ে উঠতে পারে।
এই ধরণের মানসিকতা পরিবর্তন আনাই এখন সময়ের দাবি।
স্কুল, কলেজ, এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধু ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং উদ্ভাবন ও কর্মসংস্থানের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশ প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে শ্রমবাজারে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স, স্টার্টআপ —সবই তরুণদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দরজা খুলে দিচ্ছে।
তবে এর জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন, ইন্টারনেট সেবা সহজলভ্য করা, এবং আইটি প্রশিক্ষণকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া।
বাংলাদেশকে কেবল চাকরি খুঁজে বেড়ানো তরুণদের দেশ না বানিয়ে, চাকরি সৃষ্টিকারী নেতৃত্বের দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
এই পরিবর্তন সম্ভব যদি আমরা একসাথে মিলে কর্মসংস্থান নিয়ে ভাবি, কাজ করি এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে নিজেদের বিলিয়ে দিতে পারি।
আমাদের পথ চলায় সঙ্গী হন আপনিও: