পাঁচ বছর আগে ২০২০ সালের মার্চ মাসে, যখন সারা বিশ্বে হঠাৎ করে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন ভারতের দিল্লির নিজামুদ্দিনে অনুষ্ঠিত হয় তাবলিগ জামাতের একটি ধর্মীয় সমাবেশ। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে কয়েক হাজার মুসল্লি অংশ নিয়েছিলেন। সে সময় ভারতের সরকার আচমকা সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে। এতে বহু মানুষ, বিশেষ করে বিদেশিরা, আটকে পড়েন নিজামুদ্দিনের মসজিদে। কিন্তু এরপরই সেই ধর্মীয় সমাবেশকে ঘিরে শুরু হয় বিতর্ক, দোষারোপ আর অপমান।
ভারতের কিছু রাজনৈতিক দল, কিছু টিভি চ্যানেল এবং দিল্লি পুলিশ তাবলিগ জামাতের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়—এই সমাবেশ থেকেই নাকি করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে ভারতে। এরপর শত শত ভারতীয় ও বিদেশি মুসল্লির বিরুদ্ধে ‘মহামারি আইন’, ‘বিপর্যয় মোকাবিলা আইন’, ‘বিদেশি আইন’ ইত্যাদি ধারায় মামলা দেওয়া হয়। দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছে, বিদেশিদের অবৈধভাবে আশ্রয় দিয়েছে, এমনকি ষড়যন্ত্র করেছে।
তাবলিগ জামাতে অংশ নেওয়া মুসল্লিরা প্রথম থেকেই বলছিলেন, তারা কোনো আইন ভাঙেননি। বরং হঠাৎ লকডাউনে তারা আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। কেউ কারও বাসায় আশ্রয় দিয়েছে, তা মানবতার খাতিরেই।
এই দীর্ঘ পাঁচ বছরের আইনি লড়াই শেষে অবশেষে দিল্লি হাইকোর্ট সত্যটা সামনে আনল। আদালতের বিচারপতি নীনা বনসল কৃষ্ণা স্পষ্ট ভাষায় রায়ে বলেন—“এই চার্জশিটগুলোতে কোথাও একটিও প্রমাণ নেই যে কেউ করোনা ছড়িয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “যারা অভিযোগের মুখে পড়েছিল, তারা সবাই আসলে অসহায়ভাবে আটকা পড়েছিল। কারও পক্ষেই সেই সময় ওই জায়গা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।”
দিল্লি পুলিশের করা সব ১৬টি মামলা বাতিল করে আদালত রায় দেয়—তাবলিগ জামাতের কেউ কোনো অপরাধ করেনি। কোনো নির্দেশ অমান্য করেনি। বরং তারা ছিল পরিস্থিতির শিকার।
এর আগে ২০২০ সালেই বম্বে হাইকোর্ট বলেছিল, এই মামলা করা হয়েছিল রাজনৈতিক চাপে পড়ে, এবং বিদেশিদের বলির পাঁঠা বানানো হয়েছিল। তখনও আদালত বলেছিল—“তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই।”
আজ ২০২৫ সালে এসে, পাঁচ বছর পরে যখন দিল্লি হাইকোর্ট একই কথা বলল—তখন সেটা শুধু একটি রায় নয়, বরং বহু নির্দোষ মানুষের অপবাদ থেকে মুক্ত হওয়ার দিন। দীর্ঘ সময় ধরে যারা সমাজের নানা জায়গায় অবজ্ঞা, ঘৃণা, অপমান আর সন্দেহের মুখে পড়েছিলেন, তাদের জন্য এটা এক বড় স্বস্তির খবর।
এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, পুলিশ কিংবা রাজনীতি যখন বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ায়, তখন সত্যটা সামনে আসতে সময় লাগলেও শেষ পর্যন্ত জিতে যায়। আর সেই সত্যের জোরেই আজ তাবলিগ জামাতের নিরীহ মুসল্লিরা ফিরে পেলেন সম্মান আর ন্যায়ের স্বীকৃতি।