অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অবস্থিত এক বাংলাদেশী চিকিৎসক, ডাঃ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন শাহরিয়ার, তার ক্লিনিকে একটি নবজাতক শিশুর খৎনা (Circumcision) করার পর ভুলবশত ব্যথানাশক ওষুধের পরিবর্তে শক্তিশালী আফিম (Opioid) জাতীয় ওষুধ সরবরাহ করার অভিযোগে ছয় মাসের জন্য ডাক্তারি অনুশীলন থেকে নিষিদ্ধ হয়েছেন। নিউ সাউথ ওয়েলস সিভিল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল (NSW Civil and Administrative Tribunal) গত মঙ্গলবার এই ঘটনায় ডাঃ শাহরিয়ারের রেজিস্ট্রেশন ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে রায় দিয়েছে। এই গুরুতর চিকিৎসাগত ত্রুটি এবং পরবর্তী সময়ে সংকট মোকাবিলায় চিকিৎসকের অবহেলা অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় ওষুধের নিরাপত্তা এবং চিকিৎসকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে।
ঘটনাটি ঘটেছিল ২০২৩ সালের ১ মার্চ। পশ্চিম সিডনির রেভসবি এলাকায় অবস্থিত ‘জেন্টল প্রসিডিউরস ক্লিনিক’-এর পরিচালক ছিলেন ডাঃ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন শাহরিয়ার। মাত্র ছয় দিন বয়সী একটি শিশুর খৎনার প্রক্রিয়াটি জটিলতা ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু এরপরই ঘটে মূল বিপত্তি। ডাঃ শাহরিয়ার শিশুটির বাবাকে একটি সিরিঞ্জ দেন, যাতে তিনি মনে করেছিলেন শিশুদের সাধারণ ব্যথানাশক প্যানাডল চিলড্রেন (Panadol Children) রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন—ওই সিরিঞ্জটিতে ছিল ০.৫ মিলিলিটার লিকুইড অক্সিনর্ম (OxyNorm), যা হলো অক্সিকোডন নামক একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও বিপজ্জনক আফিম জাতীয় ওষুধের ব্র্যান্ড নাম।
শিশুটি বাড়ি যাওয়ার পরই তার বাবা-মা তাকে সিরিঞ্জটি থেকে ওষুধটি প্রয়োগ করেন। ভুল বুঝতে পেরে ডাঃ শাহরিয়ার যখন শিশুটির পিতামাতাকে ফোন করেন, ততক্ষণে তারা সেই মারাত্মক আফিম জাতীয় ওষুধটি শিশুকে খাইয়ে দিয়েছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই শিশুটিকে জাগানো অসম্ভব হয়ে পড়লে উদ্বিগ্ন বাবা-মা তাকে দ্রুত লিভারপুল হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে শিশুটিকে বাঁচাতে জরুরিভাবে নালোক্সোন (Naloxone)-এর দুটি ডোজ দেওয়া হয়, যা আফিম ওভারডোজের প্রভাব প্রশমিত করতে ব্যবহৃত হয়। সৌভাগ্যবশত, যথাযথ চিকিৎসার ফলে শিশুটি রাতারাতি পর্যবেক্ষণের পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই ঘটনাটি অত্যন্ত স্পষ্ট করে দেয় যে, একটি ছয় দিন বয়সী শিশুর শরীরে এই ধরনের শক্তিশালী নারকোটিক ড্রাগ প্রবেশ করা কত বড় জীবনঘাতী হতে পারত। একটি নবজাতকের ক্ষেত্রে ০.৫ মিলিলিটার অক্সিকোডন প্রয়োগ পেশাগত দায়িত্বে চরম অবহেলার উদাহরণ।
এই দুর্ঘটনার ফলস্বরূপ, ডাঃ শাহরিয়ারকে তিনটি ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছিল এবং তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। অভিযোগগুলো ছিল—১. নীতি অনুসারে মোড়কজাত না করা বিষ সরবরাহ (supply of a poison not packaged in accordance with proper policy), ২. ওষুধের রেজিস্টার বা নথি সংরক্ষণ না করার ব্যর্থতা (failure to keep a drug register), এবং ৩. আসক্তিমূলক ওষুধ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে না পারা (failure to properly store a drug of addiction)। এই অপরাধগুলোর জন্য তাকে ২,৫০০ ডলার জরিমানা করা হয়। এই আইনি পদক্ষেপগুলোই প্রমাণ করে যে, কেবল ওষুধের ভুল প্রয়োগই নয়, বরং তার ক্লিনিকে ওষুধ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একাধিক গুরুতর ও পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল, যা এই মারাত্মক ভুলকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ট্রাইব্যুনাল পরবর্তী শুনানিতে এই সামগ্রিক ব্যর্থতাকেই তার পেশাগত অসদাচরণের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে।
এই ঘটনার পর ডাঃ শাহরিয়ারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সামনে ‘গুরুত্বপূর্ণ বিরোধ’ (significant dispute) তৈরি হয়। শিশুটির বাবা সাক্ষ্য দেন যে, ভুল ওষুধের বিষয়টি জানানোর পরও ডাঃ শাহরিয়ার তাদের তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেননি। পক্ষান্তরে, ডাঃ শাহরিয়ার জোর দিয়ে দাবি করেন যে তিনি শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল এই ক্ষেত্রে বাবার সাক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেয়। ট্রাইব্যুনাল তাদের রায়ে লেখে, “ডাঃ শাহরিয়ার যদি বাবাকে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে যেতে বলতেন, তবে বাবা কেন [শিশুটিকে] দেরি করতেন, আমরা তার কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না।” ট্রাইব্যুনাল আরও জানায়, “আশেপাশের পরিস্থিতি ডাঃ শাহরিয়ারকে তার ভুল নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন বলে সমর্থন করে না।” ডাক্তার শাহরিয়ার স্বীকার করেন যে তিনি ফোন নম্বর পর্যবেক্ষণ করেননি এবং হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করতে কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ নেননি—যেমন হাসপাতালকে পরিস্থিতি এবং দেওয়া ওষুধের সঠিক বিবরণ জানানো, যাতে শিশুটি দ্রুত চিকিৎসা পায়। বরং তিনি তার ক্লিনিকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যখন শিশুটির বাবা-মা বারবার ফোন করেও ডাঃ শাহরিয়ারের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না, তখন শিশুটির মা ওয়েস্টমিড হাসপাতালের একজন ধাত্রী (মিজ হোগান) কে ফোন করেন। মিজ হোগানই তখন পিতামাতাকে অবিলম্বে নিকটস্থ জরুরি বিভাগে যাওয়ার নির্দেশ দেন। লিভারপুল হাসপাতালের একজন নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার কনসালট্যান্ট পরে একটি বিবৃতিতে উল্লেখ করেন যে, শিশুটিকে ভর্তি করার পরও সার্কামসিশন ক্লিনিক থেকে কেউ হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করেনি বা শিশুটির অবস্থা জানতে চায়নি। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল রায় দেয় যে, ডাঃ শাহরিয়ারের আচরণ ছিল ‘তিনি যে সংকট তৈরি করেছিলেন, তার গ্রহণযোগ্য প্রতিক্রিয়ার তুলনায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুতর বিচ্যুতি’।
ডাঃ শাহরিয়ার তার একটি হলফনামায় এই অসদাচরণের জন্য তার সেই দিনের মানসিক চাপকে কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, সেদিনটি ছিল তার জন্য ‘অস্বাভাবিক এবং চাপযুক্ত’ (unusual and stressful) একটি দিন। তার স্ত্রী ফ্লু-তে অসুস্থ থাকায় ক্লিনিকে একজন কর্মী কম ছিল এবং তার নতুন বাড়িতে শাওয়ারে লিক হওয়ায় পুরো বাড়িতে জল জমছিল। ট্রাইব্যুনাল এই ব্যাখ্যা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। ট্রাইব্যুনাল লেখে, “আমরা মনে করি যে আমরা যে কোনো আদেশ দেব, তা ডাঃ শাহরিয়ারকে এই বিষয়ে আরও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করতে সহায়তা করবে যে, ২০২৩ সালের ১ মার্চ কীভাবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল—যা এই ধরনের চাপ, যা প্রত্যেকেই মাঝে মাঝে অনুভব করে, তা যেন আর কখনও না ঘটে।” অর্থাৎ, ট্রাইব্যুনাল স্পষ্টতই জানিয়ে দেয় যে, ব্যক্তিগত জীবনে আসা এই ধরনের সাধারণ চাপ কোনো পেশাদার চিকিৎসকের, বিশেষত নবজাতকের চিকিৎসার ক্ষেত্রে, বিচারিক ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে না।
ট্রাইব্যুনাল এই ঘটনাটি কেন ঘটলো, তার গভীরে গিয়ে জানায়, “যেদিন ডাঃ শাহরিয়ার ওষুধের ভুলটি করেন, সেদিন তিনি মনে করতে পারেননি যে ক্লিনিকে তার কাছে আরও তিনটি অক্সিকোডন বোতল আছে, তার কোনো ড্রাগ রেজিস্টার ছিল না, ওষুধগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষিত ছিল না, এবং খোলা বোতলটি তার চিকিৎসা কক্ষে প্যানাডল চিলড্রেনের পাশেই রাখা ছিল।” এই অসাবধানতা ও নিয়মের এই চরম লঙ্ঘনই ওষুধের ভুলটিকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ট্রাইব্যুনাল সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, এই ভুলটি ‘ওষুধের নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত ব্যর্থতার একটি ক্লাস্টারের একটি পূর্বাভাসযোগ্য পরিণতি ছিল, যা ঝুঁকি এড়ানোর জন্য তৈরি করা নিয়মাবলী উপেক্ষা করার ফল’।
ট্রাইব্যুনাল ডাঃ শাহরিয়ারকে পেশাদার অসদাচরণে (professional misconduct) দোষী সাব্যস্ত করে। তবে ট্রাইব্যুনাল মনে করে যে, তার রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা প্রয়োজন বা উপযুক্ত নয়। বরং, তার রেজিস্ট্রেশন ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয় এবং এর সাথে দুটি শর্ত আরোপ করা হয়: তাকে একটি বিশেষভাবে তৈরি শিক্ষামূলক কোর্স সম্পন্ন করতে হবে এবং একটি মেডিকেল ও প্র্যাকটিস অডিটের অধীন থাকতে হবে।
ডাঃ শাহরিয়ারের পক্ষে তিনজন সহকর্মী ডাক্তার চরিত্র সনদপত্র দেন, যার মধ্যে একজন ডাঃ ইসলামও ছিলেন, যিনি তার সাথে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ হেলথ ফোরাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ডাঃ ইসলাম তার সহকর্মীর উচ্চ প্রশংসা করে তার ‘বিভিন্ন পটভূমি এবং চ্যালেঞ্জিং জীবন পরিস্থিতিতে থাকা মানুষদের প্রতি মহান সহানুভূতি দেখানোর ক্ষমতা’-এর সাক্ষ্য দেন। তবুও, ট্রাইব্যুনাল এই ধরনের প্রশংসা সত্ত্বেও নিশ্চিত করে যে, ডাঃ শাহরিয়ার ওষুধের ভুলের পর যে সম্ভাব্য গুরুতর পরিণতি হতে পারত, তা মোকাবেলার জন্য কোনো যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, এই ভুলটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং ড্রাগ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একাধিক নিয়মের লঙ্ঘনের ফল, যা প্রমাণ করে চিকিৎসকের পেশাদারিত্বের মান গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই সীমিত শাস্তি এবং পুনর্বাসনের শর্তাবলী নির্দেশ করে যে, ট্রাইব্যুনাল চিকিৎসককে ভবিষ্যতে আবার অনুশীলনে ফিরিয়ে আনার আগে তার ভুল থেকে শেখার এবং পেশাদার আচরণের উন্নতি করার সুযোগ দিতে চেয়েছে। এই পুরো ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় ওষুধ সরবরাহ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখার গুরুত্বকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করে।
সূত্র: নোটিশার (অস্ট্রেলিয়ান গণমাধ্যম)