নিজের একটা ঘর ভেঙে ফেলা মানে যেন নিজের আত্মার ভেতরেই আঘাত করা। গত সপ্তাহে আমি নিজের ভেতরেই সেই আঘাত হানলাম। টুকরো টুকরো করে খুললাম একেকটি আসবাবপত্র—একটা একটা করে স্ক্রু আলগা করলাম, একটা একটা করে পাটাতন আলাদা করলাম— আর মনে হচ্ছিল যেন আমারই হাড়গোড় ভেঙে নিচ্ছি। নিজের জীবনকে গুটিয়ে আনলাম ছোট ছোট কাপড়ের ভাঁজে, যেন তাকে নামিয়ে আনা হলো তুচ্ছ এক জ্যামিতিতে। ঘাম ঝরছিল, নিঃশ্বাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে আসছিল, শরীরজুড়ে কম্পন আসছিল, ক্লান্তিতে নয়—বরং ক্ষতির এই বিশাল ভারে। ঘরটা ভারী হয়ে উঠল এক নীরবতায়, যে নীরবতা শান্তির নয়, বরং অভিযোগের। দেয়ালগুলো, একসময় যাদের ভেতরে ছিল আমার হাসির হালকা আবরণ, কত পরিকল্পনার নকশা, রাত জেগে কাজ করার নীরব গুঞ্জন—- আজ তারা দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক সাক্ষীর মতো আর যেন নিজেদের ত্যাগের গল্প শোনাচ্ছে। একে একে সব কক্ষ খালি করলাম—নিজের হাতে যাদেরকে গড়ে তুলেছিলাম, রঙ করেছিলাম, যত্ন নিয়েছিলাম। অবশেষে রইল শুধু আমার পদশব্দের প্রতিধ্বনি—যেন আমি নিজেই ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সেই স্থান ছেড়ে যাবার আগেই।
এরপর এলো সেই ফাঁপা ধাতব ঘণ্টাধ্বনি—উচ্ছেদের ডাক। আমরা দিনের পর দিন অপেক্ষা করলাম একটিমাত্র বাহনের অলৌকিক আবির্ভাবের আশায়। অবশেষে যখন তারা এলো, তখন সেই সাধারণ যাত্রার জন্য দাবী করলো রাজকীয় মূল্য। দশ শেকেল ভাড়ায় বিশ মিনিটের পথ —যা একসময় ছিল নিত্যদিনের যাতায়াত, এখন হয়ে উঠলো সোনায় মাপা নির্বাসন। অধিকাংশই যে মূল্য কল্পনাও করতে পারে না, মেটানো তো দূরের কথা। তাই পথ পাল্টে গেল। সেই একই রাস্তা, যা ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রত্যাবর্তনের ঢল দেখেছিল, আজ আরও একবার সাক্ষী হলো পিছু হটার, না-ফেরার স্রোতের।
আমি সেই জানুয়ারির কথা মনে করি। দেড় বছরের নির্বাসনের পরে যখন অস্ত্রবিরতি ঘোষিত হলো, মানুষ নেমে পড়েছিল গাজার পথে— সাত কিলোমিটার হেঁটে। খালি পায়ে তারা মাটিতে হেঁটেছিল, বুক ভরা ছিল ফিরে পাওয়ার আশায়। তখন রাস্তা হয়ে উঠেছিল আনন্দের সেতু, ধুলোতেও যেন ছিল বরকত। আজ সেই একই রাস্তা, জমির বুকে কাটা এক দাগ—উল্টো এক যাত্রার দলিল। এবার সে প্রত্যাবর্তনের নয়, বরং নির্বাসনের সাক্ষী। হাসি নয়, বরং হতাশার ভারী নিঃশ্বাস। আমাদের দক্ষিণগামী পথ আট ঘণ্টা লেগেছিল—এক অশেষ ভিড় আর দমচাপা হতাশার ভেতর দিয়ে যেন হামাগুড়ি দেওয়া। রাস্তা হয়ত দূরত্বের মাপে কয়েক কিলোমিটার, কিন্তু মানুষের আত্মার মাপে বুকভর্তি আশা হারানোর মাধ্যম।
কীভাবে একজন মানুষ পুরো ঘরটাকে এক ব্যাগে গুছিয়ে নিতে পারে? এটা এক অসম্ভব হিসাব। আর যারা পেরেছে, যারা তাদের সমগ্র জীবনকে কাঁধের ঝোলায় বেঁধেছে, তাদের সামনে কী আছে? নেই টাকা, নেই তাবু, নেই মাটির কোনো টুকরো যেখানে ক্ষণিকের আশ্রয় নেওয়া যায়। তাদের গন্তব্য কোনো শিবির নয়—শুধু রাস্তা। মাথার ওপর ছাদ হবে নির্লিপ্ত আকাশ আর বিছানা হবে শক্ত কংক্রিট।
আমি জানি না, আমার চোখ আর কখনো আমার ঘরের ছায়া দেখতে পাবে কিনা। এটাই সবচেয়ে গভীর ক্ষত—অপেক্ষার অনিশ্চয়তা। আর যদি ভাগ্যের আশ্চর্য খেয়ালে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়, তবে কী হবে? সেই দেয়ালগুলো কি আমাকে চিনবে? ছাদ কি আশ্রয় দেবে এমন ভঙ্গুর এক আত্মাকে, যে বারবার চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল? নাকি তালা খুলে দেখা দেবে এক অচেনা ঘর—যার ভেতর আমার স্মৃতিগুলো ধুলোয় মুছে গেছে?
আমি এই পৃথিবীকে ঘৃণা করি। ঘৃণা করি তার চকচকে নীরবতাকে, দূরের শীতল দৃষ্টিকে। ঘৃণা করি যে পৃথিবী এ দৃশ্য দেখে—আমাদের ভাঙনকে দূর থেকে দেখে—মঞ্চে কোনো আকৰ্ষণীয়, ট্র্যাজিক অভিনয় দেখার মতো—এবং তারপর চ্যানেল বদলে দেয়। এই দুঃখ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; এটা মানুষের তৈরি, উদাসীনতায় লেখা আর নীরবতায় উপস্থাপিত। আর সেই বিশাল বিশ্বজনীন নিস্তব্ধতার ভেতর, একমাত্র শব্দ হলো আমাদের ভাঙনের প্রতিধ্বনি—একটি ঘর ভাঁজ করে ফেলার নরম অথচ ভয়ানক ধাক্কা, আর নিরন্তর ক্লান্ত পদক্ষেপের দীর্ঘ পদযাত্রা, এমন এক রাস্তায় যা কখনও শেষ হয় না।
মূল লেখা: The Soft Thud of a Folded Home: The Moment I Walked Away, Leaving Myself Behind