ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে কলকাতার সঙ্গে একটি নতুন বিকল্প সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে ভারত, যেখানে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে পাশ কাটিয়ে নৌপথে সংযোগ গড়ে তোলা হবে। এই সংযোগের অন্যতম অংশ হচ্ছে শিলং থেকে সিলচর পর্যন্ত ১৬৬.৮ কিমি দীর্ঘ একটি চার লেনের হাইস্পিড করিডোর, যা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রথম এই ধরণের প্রকল্প।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ন্যাশনাল হাইওয়েজ অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (NHIDCL)-এর এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, এই প্রকল্পটি মূলত মিয়ানমারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাল্টি-মডাল পরিবহন প্রকল্পের সম্প্রসারণ হিসেবে কাজ করবে। এটি শিলং-সিলচর হাইওয়ের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য কলকাতা হয়ে সমুদ্রপথে বিকল্প যোগাযোগের সুযোগ করে দেবে। এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের এক মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এসেছে বলেও জানান তিনি। মার্চ মাসে বেইজিংয়ে ইউনুস বলেছিলেন, “উত্তর-পূর্ব ভারত মূলত ল্যান্ড-লকড, আর এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রপথে প্রবেশের একমাত্র অভিভাবক হচ্ছে ঢাকা।” এরপর ৪ এপ্রিল বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ইউনুস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে মোদী তাকে জানান, এ ধরনের “উস্কানিমূলক” মন্তব্য পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
এই নতুন হাইওয়ের ১৪৪.৮ কি.মি. পড়বে মেঘালয়ে ও ২২ কি.মি. আসামে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২২,৮৬৪ কোটি রুপি, যা ৩০ এপ্রিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়। এটি ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। এই রাস্তাটি তৈরি হলে বর্তমানে ৮ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের যাত্রা সময় কমে হবে মাত্র ৫ ঘণ্টা। NHIDCL কর্মকর্তা জানান, এটি শুধুই প্রথম হাইস্পিড করিডোর নয়, বরং পাহাড়ি অঞ্চলে প্রথম এমন প্রকল্প। সিলচর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ—যার মাধ্যমে মিজোরাম, ত্রিপুরা, মণিপুর ও বরাক উপত্যকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হবে। এই করিডোর ভারতের “অ্যাক্ট ইস্ট” নীতিকে বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রাখবে।
এই প্রকল্পের সমান্তরালে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে কালাদান মাল্টি মডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প মিয়ানমারে বাস্তবায়ন হচ্ছে, যার মাধ্যমে কলকাতা বন্দর থেকে সিথুয়ে (রাখাইন প্রদেশ) পর্যন্ত সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন হবে। সেখান থেকে পালেটওয়া পর্যন্ত নৌপথ ও এরপর মিজোরামের জোরিনপুই পর্যন্ত সড়কপথে সংযোগ গড়ে তোলা হবে। এই রুটের মাধ্যমে বিশাখাপত্তম ও কলকাতা থেকে পণ্য বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি উত্তর-পূর্ব ভারতে পৌঁছাতে পারবে। ফলে সিলিগুড়ি করিডোরের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। বর্তমানে সিলিগুড়ি করিডোর, বা ‘চিকেনস নেক’, ভারতের মূল ভূখণ্ড ও উত্তর-পূর্বের মধ্যে একমাত্র সরাসরি স্থল সংযোগ।
এই হাইওয়ে নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হবে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব রক মেকানিক্সকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পাথর ও ঢালু অঞ্চলের বিশদ বিশ্লেষণে। ব্যবহৃত প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে, LiDAR স্ক্যানিং (টপোগ্রাফিক জরিপের জন্য), শক্তিশালী রক অ্যাঙ্কর (হাই-স্ট্রেংথ ওয়্যার মেশ প্যানেল ও সুরক্ষা প্রাচীর), পিয়েজোমিটার, রেইন গেজ, ইনক্লাইনোমিটার, সেটেলমেন্ট গেজ ও জিওফোনস – যেগুলো ভূমিধস ও কম্পন পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হবে
এই প্রকল্পটি হাইব্রিড অ্যানুইটি মোড (HAM)-এ বাস্তবায়িত হবে, যা একটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেল। এতে থাকবে ১৯টি বড় সেতু, ১৫৩টি ছোট সেতু, ৩২৬টি কালভার্ট, ২২টি আন্ডারপাস, ২৬টি ওভারপাস, ৮টি লিমিটেড হাইট সাবওয়ে এবং ৩৪টি ভায়াডাক্ট। যদিও প্রকল্পটির কৌশলগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য, তবুও বিশেষজ্ঞ মহলে প্রশ্ন উঠেছে—এটি বাস্তবায়ন কতটা সম্ভবপর? ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পূর্ববর্তী বহু অবকাঠামোগত প্রকল্পই নানা কারণে বিলম্বিত হয়েছে: রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভৌগোলিক প্রতিকূলতা, বন ও পরিবেশ অনুমোদন, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা এবং পর্যাপ্ত তহবিল না থাকা অন্যতম বাধা।
বিশেষত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিও কালাদান প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। একইভাবে, দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে প্রকৌশলগত জটিলতা এবং প্রকল্প পরিচালনার দীর্ঘসূত্রিতা ভবিষ্যতে ব্যয় ও সময়সীমা বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই পরিকল্পনা ভারতের কৌশলগত স্বার্থে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে, যদি তা সময়মতো এবং কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়। অন্যথায় এটি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে, আর বাংলাদেশকে ঘিরে ভূরাজনৈতিক নির্ভরতা ভারতের থেকেই যাবে। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নের গতিবিধি ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় কতটা মসৃণভাবে এগোয়, সেটিই এখন দেখার বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।