পেহেলগাম হামলা: উপমহাদেশে অশান্তির নতুন ইন্ধন? - দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ
নোটিশ:
শিরোনামঃ
নিয়োগে নেই সুপারিশের প্রভাব, নোবিপ্রবিতে শিক্ষক নিয়োগে নতুন ধারা নতুন রুটে ক্যানারির পথে অভিবাসন: বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি ‘গবেষণা পদ্ধতি’ শীর্ষক দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হলো জাককানইবিতে ঝগড়ারচর বাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কোটি কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই নালিতাবাড়ীতে পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানে ৩ কারবারি গ্রেফতার শেকৃবিতে আন্তঃঅনুষদ ক্রিকেটে বিজয়ী কৃষি অনুষদ ঢাকা-ময়মনসিংহে সকল সেবার জন্য অনলাইন জিডি চালু স্ত্রী-সন্তানসহ প্রবাসীর রহস্যমৃত্যু, আলামতে ষড়যন্ত্রের গন্ধ চীনের ভয়ঙ্কর মশা ড্রোন: গুপ্তচরবৃত্তির নতুন অধ্যায় প্রেমিকার টানে কাঁটাতার পেরিয়ে বাংলাদেশে, লালমনিরহাটে ভারতীয় যুবক আটক

পেহেলগাম হামলা: উপমহাদেশে অশান্তির নতুন ইন্ধন?

ডা. মেহেদুজ্জামান
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫
  • ১৩৩ বার দেখা হয়েছে

পেহেলগাম, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের অতি সুন্দর এক উপত্যকা, যাকে বলা হয় মিনি সুইজারল্যান্ড। সেই পেহেলগামেরই রিসোর্টে পর্যটকদের বিরাট একটি দল অবস্থান করছিল। সে সময় কেউ খাচ্ছিল, কেউ ছবি তুলছিল। ঠিক এই সময় তিন থেকে পাঁচজনের একটি দল সেনাবাহিনীর পোশাক পরা সৈনিকের ছদ্মবেশে সেই রিসোর্টে প্রবেশ করে এবং এলোপাথাড়ি গুলি চালায়, যার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ২৮ জন পর্যটক নিহত হয়।

এই প্রেক্ষাপটে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কের টালমাটাল অবস্থা। ইতিমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার সৌদি আরব সফর সংক্ষিপ্ত করে ভারতে ফিরে এসেছেন। পাকিস্তানিদের জন্য ভারতে সার্ক ভিসা বাতিল করা হয়েছে। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার সিন্ধু নদী চুক্তি বাতিল করা হয়েছে এবং একটি যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবিকই কি ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হবে? যুদ্ধ হলে ঠিক কী কারণে হবে? এই হামলার জন্য? যদি এই হামলার জন্যই হয়, তাহলে এই হামলা কে করালো? এই হামলার উদ্দেশ্য কী? এবং এই হামলা থেকেই কেন ভারতে-পাকিস্তান যুদ্ধ লেগে যেতে পারে?

এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, ভারতের সরকারি তথ্যমতে সেই হামলার দায় স্বীকার করেছে কাশ্মীর রেজিস্টেন্স ফ্রন্ট (TRF) নামের একটি দল। পরবর্তীতে TRF আনুষ্ঠানিকভাবে দায় অস্বীকার করেছে। ভারতের দাবি অনুযায়ী, তারা পাকিস্তানপন্থী। যদিও পাকিস্তান এই হামলার দায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। অর্থাৎ বল এখন ভারতের কোর্টে। ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে পাকিস্তানের প্রতি এবং মনে হচ্ছে যেকোনো সময় একটি যুদ্ধাবস্থা তৈরি হবে।

এই অবস্থা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন নয়। এর আগেও আমরা দেখেছি, ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে, ২০১৯ সালের দিকে পুলওয়ামাতে হামলা হয় এবং সেখানে ভারতীয় সৈনিকদের অনেকেই নিহত হয়। তারপর ভারত কথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালায়। যদিও সেই স্ট্রাইক নিয়ে নানাজনের নানা বিতর্ক আছে। অনেকেই বলে, সেই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ছিল শুধুই একটা আই ওয়াশ। এর ফলে তখনকার মতো বিষয়টা আপাতত ‘ধামাচাপা’ হয়।

এখন আমরা আসি, হঠাৎ করে এই পরিস্থিতি ঠিক কী কারণে তৈরি হলো। স্বাভাবিকভাবেই কোনো যুদ্ধে নিরীহ মানুষদের টার্গেট করা সেই যুদ্ধের নীতির মধ্যে পড়ে না। গেরিলা যুদ্ধের নীতির মধ্যেও পড়ে না। ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে যেই দলগুলো যুদ্ধ করে, তারা বেশিরভাগই স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী। তারা কাশ্মীরকে স্বাধীন করতে চায়। এই গোষ্ঠীগুলো বরাবরই ভারতের পুলিশ, ভারতের সৈনিক, সিআরপিএফ—এদেরকেই টার্গেট করে এসেছে। আমরা বরাবরই দেখে এসেছি। এর বাইরেও আমরা কোথাও কোথাও দেখেছি, বহিরাগত শ্রমিকদের কাউকে কাউকে টার্গেট করা হয়েছে। কিন্তু বিরাট সংখ্যক পর্যটককে টার্গেট করার ঘটনা এই প্রথম।

এর আগেও যতবার এই ঘটনাগুলো ঘটেছে—২০০০ সালে, তারও আগে ১৯৯৬ সালে—সেই সময় সেটা হয়েছিল যে, ভারত থেকে যাওয়া তীর্থযাত্রীদের টার্গেট করা হয়েছিল, তারা নেহায়েত পর্যটক ছিল না, ছিল তীর্থযাত্রী। কিন্তু এবারই প্রথম এক বড় সংখ্যক পর্যটকের ওপর আঘাত করা হয়েছে।

এখন বিষয় দুটি: এদেরকে আক্রমণ করলো কে? দায় অস্বীকার করেছে যে কাশ্মীরী গোষ্ঠী, সেই রেজিস্ট্যান্স গ্রুপ। তারাই কি আসলে টার্গেট করেছে? এই গ্রুপের ব্যাকআপ কে? তারা কি আসলেই পাকিস্তানপন্থী? নাকি এটা ভারতের একটা ইন্টারনাল জব বা ভেতরের কাজ?

TRF পাকিস্তানের দায় অস্বীকার এবং কোনো প্রমাণ ছাড়া ভারতের পাকিস্তানের প্রতি অতিপ্রতিক্রিয়া সন্দেহজনক, বিশেষ করে দিল্লির মসনদে যখন উগ্র ডানপন্থী বিজেপি ক্ষমতায়, যাদের মূল অস্ত্র ধর্মীয় সুড়সুড়ি এবং জনতুষ্টিবাদ।

পুলওয়ামা হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অনেকেই বলে থাকেন যে, ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে যখন মোদি সরকারের জনপ্রিয়তা মোটামুটি তলানিতে, সে সময় জাতীয় নির্বাচনে হেরে যেতে পারে ভেবে বিজেপি সরকার পুনরায় হত্যাকাণ্ড চালায় এবং সে সময় প্রায় চল্লিশের অধিক সৈন্য (সিআরপিএফ) মারা যায়।

এখন এই মুহূর্তে ভারত সেই অবস্থায় আছে যে, ভারতের সাথে রাজনীতির বাকি দেশগুলোর কী অবস্থা, ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কী অবস্থা বিরাজমান, সেটা যদি দেখি তাহলে দেখা যাবে—

এই মুহূর্তে ভারতের সাথে চীনের সম্পর্ক খুব খারাপ। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল বাংলাদেশের সাথে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক একেবারে তিক্ততায় রূপ নিয়েছে। শ্রীলঙ্কার সাথেও সম্পর্ক খারাপ। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক আগে থেকেই খারাপ। নেপালের সাথেও সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না বহুদিন ধরে। আছে শুধু ভুটান, যারা আসলে শক্তিশালী কোনো প্রতিবেশী নয়।

আমেরিকার ট্রাম্প সরকারের সাথে ভারত যদিও মুখে মুখে বলছে সম্পর্ক ভালো, কিন্তু ট্রাম্প আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিচ্ছেন না ইসরায়েল ব্যতীত। ভারতকে তো আরো নয়। ভারতের উপর উচ্চ হারে ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে, যার ফলে ভারত ও আমেরিকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ব্যাহত হওয়ার তীব্র সম্ভাবনা রয়েছে।

একইভাবে রাশিয়াকে সমর্থন করার কারণে পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথেও ভারতের সম্পর্ক খারাপ। মুসলিমদের উপর নির্যাতনের কারণে মুসলিম বিশ্বের বাকি দেশগুলোর সাথেও সম্পর্ক খুব একটা ভালো না।

এই সময়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারের জনপ্রিয়তা কিছুটা কমতির দিকে। এখন সেই জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করার জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকার কি সেই পুরনো কৌশলই অবলম্বন করল কিনা—যে নিজের জনগণ বা নিজের সৈনিকদের হত্যা করে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানো—এমনটা কি উড়িয়ে দেওয়ার মত?

আবার যদি পাকিস্তানের দিকে তাকাই, হ্যাঁ, এটাও সত্য যে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিভিন্ন প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানের যোগাযোগ বহুদিন থেকেই আছে—এটা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট। এই মুহূর্তে পাকিস্তান স্পন্সর করে ভারতে হামলা চালাবে—এটা কি খুব বাস্তবসম্মত?

কারণ পাকিস্তান নিজেও খুব ভালো অবস্থায় নেই। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। পাশের প্রতিটি দেশের সাথে ঝামেলা। নানা ধরনের হামলা চলছে। ভারতের সাথে সম্পর্ক আগে থেকেই খারাপ।

আফগানিস্তানে তালেবান সরকার আসার পর থেকে ভেবেছিল সম্পর্ক উন্নয়ন হবে, কিন্তু দিন দিন তা আরো খারাপ হচ্ছে। খাইবার পাখতুন প্রদেশে প্রতিনিয়ত তেহরিক-ই-তালেবান বা পাকিস্তান তালেবান হামলা করছে এবং সৈনিকদের প্রাণ কাড়ছে। গত এক বছরে প্রায় চার-পাঁচ শতাধিক সেনাসদস্য প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও রয়েছেন।

এর বাইরে বেলুচিস্তানে, পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় খনিজসম্পদপূর্ণ প্রদেশে, বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি অনেক বছর ধরেই স্বাধীনতার জন্য লড়ছে এবং মাঝে মাঝে তীব্র হামলা চালাচ্ছে। বিশেষ করে তারা বেসামরিক নাগরিকদেরও টার্গেট করছে।

সিন্ধু, করাচি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে তাদের হামলা। পাঞ্জাবেও হামলা হচ্ছে। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের অবস্থা একেবারে স্থিতিশীল না।

একইসাথে ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশের শাখা, শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে পাকিস্তানে চরম টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে।

এ সময়ে পাকিস্তান কি ভারতের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত? পাকিস্তান কি ভারতে হামলা করাবে? পাকিস্তান-স্পন্সর কোনো গোষ্ঠী ভারতে হামলা চালাবে? এ কথাগুলো খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য নয়।

এখানে দুটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা: হতে পারে এটি মোদি সরকারের নিজস্ব কাজ, অথবা কোনো গোষ্ঠীর কাজ যাতে পাকিস্তান সরকারের সমর্থন আছে। সম্ভাবনা ঠিক কোনটি, তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল।

এখন কথা হচ্ছে—যদি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লেগেই যায়, যদিও সেই সম্ভাবনা খুব কম, বা নেই বললেই চলে। এর আগেও এর চেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে—ডিপ্লোম্যাট প্রত্যাহার, যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়া—তবুও যুদ্ধ লাগেনি।

বর্তমানে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি খুবই নাজুক। গণতান্ত্রিক অবস্থা আরও করুণ। সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরান খান জেলে। তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফ কার্যত কোনো কাজ করতে পারছে না। এ অবস্থায় পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে জড়ানো সম্ভব না। জড়ালেও তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

ভারতের পক্ষে সুবিধা হচ্ছে—তারা বড় দেশ, বিশাল অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক প্রভাব বেশি, পশ্চিমাদের কিছুটা হলেও সমর্থন আছে, যুদ্ধ চালানোর সামর্থ্যও আছে। সামরিক শক্তিতে পাকিস্তানের চেয়ে বহু গুণ এগিয়ে।

কিন্তু ভারতও একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালানো তাদের পক্ষে কঠিন। অর্থনীতি করোনার পর থেকেই সংকুচিত, জিডিপি গ্রোথ কমছে, প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় বাণিজ্য ও কূটনীতিতে ক্ষতি হচ্ছে।

তারপরও ভারত সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। কিন্তু সমস্যা চীন। চীন ভারতের বিরোধী, এবং এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে তারা দ্বিধা করবে না। সেভেন সিস্টার অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়তে পারে। চীনের নজর লাদাখ, অরুণাচলের উপর অনেকদিন ধরেই। সুতরাং চীন এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার। ভারতের মূল বাধা—দুর্বল অর্থনীতি ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক।

শেষ কথা, ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব নির্ধারণ করবে তারা কেমন উপমহাদেশ চায়—শান্ত না উত্তপ্ত। উভয়েই পারমাণবিক শক্তিধর, অলআউট যুদ্ধ শুরু হলে তা কারো জন্যই সুখকর হবে না।

 

ডা. মেহেদুজ্জামান, জামালপুর।

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT