পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে আবারও সীমান্ত উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। চলতি সপ্তাহে কাবুলে পাকিস্তানের বিমান হামলার অভিযোগের পর দুই দেশের বাহিনী সীমান্তে ভয়াবহ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। শনিবার (১২ অক্টোবর) দুই দেশের নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, সীমান্তের ছয়টিরও বেশি স্থানে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে এবং রাতভর দুই দেশের সেনাদের মধ্যে ভারী অস্ত্রের লড়াই চলে।
পাকিস্তানের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলেন, আফগানিস্তান থেকে বিনা উসকানিতে তাদের সীমান্ত চৌকিগুলোর দিকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তারা দাবি করেন, সেই গুলির জবাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘পূর্ণ শক্তি দিয়ে’ পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানায়। কর্মকর্তারা আরও জানান, সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে আফগান বাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ চালানো হয়েছে। এতে আফগানিস্তানের ভেতরে অবস্থিত কয়েকটি সামরিক চৌকি ধ্বংস হয়েছে বলেও দাবি করে ইসলামাবাদ।
অন্যদিকে, আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় হেলমান্দ প্রদেশের স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তালেবান বাহিনী অন্তত তিনটি পাকিস্তানি সীমান্ত চৌকি দখল করার দাবি করেছে। আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এনায়েতুল্লাহ খোয়ারাজমি বলেন, পাকিস্তানের বিমান হামলা ও আকাশসীমা লঙ্ঘনের জবাবে আফগান বাহিনী পাল্টা অভিযান পরিচালনা করেছে। তার ভাষায়, “এই অভিযান ছিল আত্মরক্ষামূলক। যদি পাকিস্তান আবারও আফগান আকাশসীমা লঙ্ঘন করে, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী আকাশসীমা রক্ষায় প্রস্তুত এবং কঠোর জবাব দেবে।”
রয়টার্সের প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজ ও পাকিস্তানি সেনা সূত্রের দেওয়া চিত্রে দেখা গেছে, সীমান্তের দুই পাশে গোলাবর্ষণে রাতের আকাশ আলোকিত হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শেয়ার করা কিছু ক্লিপে গোলা ও রকেট নিক্ষেপের দৃশ্যও ধরা পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সীমান্তবর্তী এলাকায় গোলাবর্ষণের শব্দে রাতভর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যান।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডন জানায়, আফগান তালেবান বাহিনী বিনা উসকানিতে সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাল্টা জবাব দেয়। এতে আফগানিস্তানের একাধিক সামরিক অবস্থানে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয় বলে দাবি ইসলামাবাদের। ডনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারী কামান, ট্যাংক এবং মেশিনগানসহ আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করছে।
এই সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে গত বৃহস্পতিবার, যখন আফগানিস্তান অভিযোগ তোলে যে পাকিস্তান কাবুল এবং পূর্বাঞ্চলীয় পাকতিকা প্রদেশে বিমান হামলা চালিয়েছে। ওই হামলায় বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে বলে দাবি করে তালেবান সরকার এবং প্রতিশোধ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়। ইসলামাবাদ ওই হামলার অভিযোগ স্বীকারও করেনি, আবার সরাসরি অস্বীকারও করেনি। তবে পাকিস্তান কাবুলকে আহ্বান জানায়, পাকিস্তানবিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে।
উভয় দেশের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, উভয় দিকেই সৈন্য হতাহত হয়েছে এবং সীমান্তের কয়েকটি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংঘর্ষের কারণে সীমান্তবর্তী বেশ কিছু বাণিজ্যিক প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়েছে পাকিস্তান, ফলে পণ্য পরিবহন ও স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই নতুন সংঘর্ষ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ইতিমধ্যেই জটিল সম্পর্ককে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ইসলামাবাদ ও কাবুলের মধ্যে দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস ও সীমান্ত বিরোধ এর পেছনের মূল কারণ। বিশেষত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের কার্যক্রম ও আফগান ভূখণ্ডে তাদের উপস্থিতি পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও সীমান্ত স্থিতিশীলতার জন্য এই সংঘর্ষ মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। জাতিসংঘসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা দুই পক্ষকেই সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। তবে কাবুল ও ইসলামাবাদ থেকে এখনো শান্তিপূর্ণ আলোচনায় ফেরার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্তে চলমান এই সশস্ত্র উত্তেজনা যদি অব্যাহত থাকে, তবে এটি শুধু দুই দেশের নয়, গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।