বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় শিশু-কিশোরদের অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’ আবারও ফিরে এসেছে দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর। প্রায় ২০ বছর বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় নতুন রূপে শুরু হয়েছে এই অনুষ্ঠান, যা একসময় ঘরে ঘরে শিশুদের প্রাণের প্রতিযোগিতা হয়ে উঠেছিল।
১৯৭৬ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোস্তফা মনোয়ারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ‘নতুন কুঁড়ি’র যাত্রা শুরু হয়। কবি গোলাম মোস্তফার কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এর নামকরণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শিশু প্রতিভা খুঁজে বের করে জাতীয় মঞ্চে তুলে ধরা। এই মঞ্চ থেকেই গড়ে উঠেছেন অসংখ্য তারকা—নুসরাত ইমরোজ তিশা, রুমানা রশিদ ঈষিতা, মেহের আফরোজ শাওন, কনকচাঁপা, সামিনা চৌধুরী, চাঁদনীসহ অনেকেই। সংগীত, অভিনয় ও নৃত্যসহ সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় যারা আজ উজ্জ্বল নক্ষত্র, তাদের অনেকেরই শুরু হয়েছিল এই আয়োজন থেকে।
২০০৬ সালে হঠাৎ করেই অনুষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জাতীয় পর্যায়ে শিশু-কিশোরদের জন্য কোনো সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্মের অভাব তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ কারণে এক প্রজন্ম সাংস্কৃতিক চর্চা থেকে সরে গিয়ে অনলাইন নির্ভরতায় ঝুঁকে পড়েছিল।
অবশেষে ২০২৫ সালের ১৭ আগস্ট নতুন করে সূচনা হয় ‘নতুন কুঁড়ি ২০২৫’-এর। উদ্বোধন করেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির এই আয়োজন আগামী প্রজন্মকে সৃজনশীল করে তুলবে। এটি একটি নতুন যুগের সূচনা।”
নতুন কুঁড়ির এবারের আয়োজনকে করা হয়েছে আরও আধুনিক ও বিস্তৃত। দেশকে ভাগ করা হয়েছে ১৯টি অঞ্চলে, যেখানে অনুষ্ঠিত হবে আঞ্চলিক বাছাইপর্ব। নির্বাচিত প্রতিযোগীরা ঢাকায় এসে চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেবেন। অংশগ্রহণকারীদের দুটি বয়সভিত্তিক শাখায় ভাগ করা হয়েছে—ক (৬-১১ বছর) এবং খ (১১-১৫ বছর)। প্রতিযোগীরা সর্বোচ্চ তিনটি বিষয়ে অংশ নিতে পারবেন।
এবারের প্রতিযোগিতায় থাকছে ১২টি বিভাগ—দেশাত্মবোধক গান, আধুনিক গান, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, লোকসংগীত, হামদ-নাত, অভিনয়, আবৃত্তি, গল্প বলা, কৌতুক, সাধারণ নৃত্য ও উচ্চাঙ্গ নৃত্য। প্রতিটি বিভাগে থাকবেন অভিজ্ঞ বিচারক, আর বিচার প্রক্রিয়া হবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ।
অনুষ্ঠানের পুনর্জাগরণ ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নস্টালজিয়ার ঢেউ উঠেছে। প্রাক্তন প্রতিযোগীরা শৈশবের স্মৃতি মনে করে লিখছেন—“শুক্রবার মানেই ছিল নতুন কুঁড়ি।” শিল্পী কনকচাঁপা স্মৃতিচারণ করে বলেন, “১৯৭৮ সালে মাত্র সাত বছর বয়সে নতুন কুঁড়িতে প্রথম হয়েই আমি সংগীত জীবনের পথে হাঁটা শুরু করি। নতুন কুঁড়ি আজও শিশুদের স্বপ্ন গড়ার প্ল্যাটফর্ম।”
একইভাবে প্রাক্তন বিজয়ী আজাদ রহমান শাকিল বলেন, “এই অনুষ্ঠান শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, এটি শিশুদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা প্রতিভা আবিষ্কারের মহামঞ্চ। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের আলোকবর্তিকা।”
বিটিভির মহাপরিচালক মো. মাহবুবুল আলম একে ‘সাংস্কৃতিক জোয়ার’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “নতুন কুঁড়ি কেবল প্রতিযোগিতা নয়, এটি জাতীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এটি শিশু-কিশোরদের সংস্কৃতিমুখী করবে এবং প্রযুক্তির আসক্তি থেকে দূরে রাখবে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই নতুন কুঁড়ি শত বছর ধরে নিয়মিতভাবে চলুক।”
শিশুদের জন্য এই অনুষ্ঠান শুধু প্রতিভা বিকাশ নয়, বরং শৃঙ্খলা, আত্মবিশ্বাস ও জাতীয়তাবোধ শেখারও একটি বিদ্যালয়। অভিভাবকরাও আশাবাদী যে জাতীয় মঞ্চে ওঠার সুযোগ শিশুদের জীবনে বড় পরিবর্তন আনবে।
সব মিলিয়ে, প্রায় দুই দশক পর নতুন করে শুরু হওয়া ‘নতুন কুঁড়ি ২০২৫’ কেবল একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান নয়, বরং হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্যের পুনর্জন্ম। এটি আগামী প্রজন্মের প্রতিভাকে জাতীয়ভাবে পরিচিত করবে এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভুবনকে আলোকিত করবে নতুন নতুন তারায়।