পশ্চিমবঙ্গের মালদার জলালপুর গ্রামের কৃষিজীবী পরিবারে জন্ম ২২ বছরের শেখ আমিরের। বাড়ির বড় ছেলে। ঘরে বৃদ্ধ বাবা, মা, ছোট দুই ভাই—সবাই তাকিয়ে ছিল তার আয়-রোজগারের দিকে। জীবনের স্বপ্ন ছিল সোজা—কাজ করে সংসার চালাবেন, ভাইদের পড়াবেন, বাবাকে স্বস্তি দেবেন। সেই স্বপ্ন নিয়েই তিনি গিয়েছিলেন রাজস্থানে। কিন্তু রাজস্থান হয়ে এখন তিনি রয়েছেন বাংলাদেশে, সম্পূর্ণভাবে অনিচ্ছায়, নিঃস্ব, অপমানিত, পরিচয়হীন এক মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে।
ঘটনার সূত্রপাত প্রায় দুই মাস আগে। কাজের খোঁজে রাজস্থানে পৌঁছানোর কিছুদিন পরেই একদিন পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। পুলিশ তাঁকে প্রশ্ন করে—“আপনি ভারতীয় তো?” তিনি উত্তরে আধার কার্ড, ভোটার আইডি, এমনকি আত্মীয়দের পরিচয়পত্রও দেন। কিন্তু সেসব গ্রহণ করেনি পুলিশ। তাঁকে প্রথমে তিন দিন থানায় আটকে রাখা হয়, তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হয় জেলে। জেলে কেটেছে তার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার দিনগুলো। নিজের পরিবার বা পরিচিত কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পর্যন্ত পাননি। আমির শেখ আর তাঁর বাবা জিয়েম শেখ কাঁদছেন ভিডিও বার্তায়—“ছেলেকে কি আর ফিরে পাব?” বাবা ও ছেলের কান্নার ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
সবচেয়ে চমকে ওঠার মতো ঘটনা ঘটে তখন, যখন জেল থেকে মুক্তির বদলে তাঁকে হস্তান্তর করা হয় বিএসএফের হাতে। আর এক ভোরবেলা তাঁকে চোখে কাপড় বেঁধে, রাস্তা না চিনতে দিয়ে সীমান্ত পার করে ঠেলে দেওয়া হয় বাংলাদেশে। এই ‘পুশইন’ (Push-in) এর শিকার হয়ে একেবারে নিঃস্ব আমির এখন বাংলাদেশে খাবার, আশ্রয় ও নিজের পরিচয় নিয়ে দিশেহারা অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
তাঁকে প্রথম খুঁজে পান ব্যবসার কাজে বাংলাদেশের ঘুমরায় আসা ভারতীয় ব্যবসায়ী পবন কুমার দাস। রাস্তায় কান্নারত যুবকটিকে দেখে থমকে যান তিনি। পরিচয় জানতে চেয়ে জানতে পারেন—ছেলেটি মালদার আমির শেখ। পবন তখন তাঁকে খাবার দেন, থাকার ব্যবস্থা করেন এবং একটি ভিডিও ধারণ করে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেন। সেই ভিডিওতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমির বলেন, “আমি ভারতীয়, মালদার জলালপুরের বাসিন্দা। কিন্তু রাজস্থানে পুলিশ আমাকে সন্দেহ করে। সব নথি দেখিয়েও আমাকে বিশ্বাস করা হয়নি। শেষে তারা আমাকে জেল খাটিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়।”
ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়তেই বিষয়টি নজরে আসে কালিয়াচক থানার পুলিশ ও পশ্চিমবঙ্গ অভিবাসী শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডের। এরপর মালদা জেলা প্রশাসন বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেয়। জেলা প্রশাসক নীতিন সিংহানিয়া নিশ্চিত করেছেন, “আমির জলালপুর গ্রামের বাসিন্দা। তাঁকে ফেরাতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।” বিডিও ইতোমধ্যে আমিরের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দৃষ্টিও আকৃষ্ট করা হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছবি দেখা গেছে আরেকটি ভিডিওতে। সেটি ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, যেখানে আমিরের বাবা জিয়েম শেখ কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, “আমার ছেলে তো কোনোদিন দেশ ছাড়েনি। রাজস্থানে কাজ করতে গিয়েছিল। ওর কাছে সবকিছু ছিল—আধার, ভোটার, আত্মীয়দের কাগজ। তবু তারা ওকে বিশ্বাস করল না! এখন সে কোথায়? কেমন আছে? খেয়েছে কি না জানি না। পবন সাহেব না থাকলে তো আমার ছেলের খোঁজই পেতাম না। আল্লাহ তাকে ভালো রাখুন।”
এই দৃশ্য দেখে চোখ ভিজেছে অসংখ্য মানুষের। একদিকে ছেলের কণ্ঠে কান্না আর অসহায়তা, অন্যদিকে বাবার কণ্ঠে আকুতি—এই দুই ভিডিওতেই ফুটে উঠেছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা, যা প্রশ্ন তো তোলে ভারতের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ভুলের, আবার আমাদের আন্তর্জাতিক মানবিক দায়িত্ববোধকেও।
এই ঘটনার পর কংগ্রেস এমপি ঈশা খান চৌধুরী সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি পাঠিয়ে লেখেন, “একজন প্রকৃত ভারতীয় নাগরিককে এভাবে অন্য দেশে ঠেলে দেওয়া গভীর মানবিক লঙ্ঘন এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।”
এখন মালদা জেলা প্রশাসন চেষ্টা করছে বাংলাদেশে আটকে পড়া আমির শেখকে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশাসন যদি তাঁকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে ধরে, তাহলে আইনি জটিলতা আরও বাড়বে—এমন আশঙ্কা পবন কুমার দাসেরও।
এই মুহূর্তে আমির শেখ রয়েছেন পবন দাসের বাংলাদেশি সহযোগীর তত্ত্বাবধানে। খাবার পেয়েছেন, আশ্রয় পেয়েছেন। কিন্তু নিজের দেশ, নিজের মাটি, নিজের পরিচয়—এই তিনটিই আজ তাঁর কাছে অধরা।
বাবা জিয়েম শেখ প্রতিদিন ভোরে ওঠেন ছেলের খবর পাওয়ার আশায়, কিন্তু কেবল কান্না আর শূন্যতা নিয়ে আবার বসে পড়েন উঠোনে। ছেলের সেই ছবি, কান্নার ভিডিও—সব এখন মোবাইলে বাজে, কিন্তু মুখোমুখি দেখা নেই।
এ এক নির্মম বাস্তবতা—যেখানে পরিচয়ের সব প্রমাণ থাকার পরও অস্বীকার করা হয় নাগরিকত্ব। আর একদিন ভোরে নিজেকে আবিষ্কার করতে হয় অন্য একটি দেশের মাটিতে।