জামায়াতে ইসলামীর সাবেক শীর্ষ নেতা গোলাম আযমের পুত্র আব্দুল্লাহিল আমান আযমী সম্প্রতি এক গণমাধ্যমের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ এবং তার সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
গোলাম আযমের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তের পেছনে তার পুত্র আব্দুল্লাহিল আমান আযমী প্রধানত ভারতের আধিপত্যবাদের আশঙ্কাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, তাদের অবস্থান ছিল ভারত-কেন্দ্রিক সাহায্যের বিরোধী। গোলাম আযম স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ যদি ভারতের সাহায্য না নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতো, তবে তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতেন। এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তাদের কাছে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার বা আধিপত্যবাদী আকাঙ্ক্ষা রোধ করা ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও দাবি করেন যে, তার বাবাকে নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে, তা মূলত ভারতের একটা প্রপাগান্ডা। তাদের (বিরোধী পক্ষের) ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে গোলাম আযমের যে আদর্শ, তা মোকাবেলা করার ক্ষমতা নেই। একারণেই তারা ইসলামকে সরাসরি আক্রমণ না করে ১৯৭১ সাল থেকে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে এসেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
গোলাম আযমের পুত্র হিসেবে আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর সেনাবাহিনীতে যোগদান এবং পদোন্নতির পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। তিনি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীতে সুযোগ পেলেও, তাকে প্রতি পদে পদে কঠোর বিরোধিতা ও জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়েই তার যোগদানের নির্দেশ বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি তার যোগদানের কথা থাকলেও, তার পূর্বেই, ১৯৭৯ সালের ২৭ অথবা ২৮ জানুয়ারি, সেনা সদর থেকে একটি চিঠি দিয়ে সেই যোগদান সাময়িকভাবে বাতিল করে দেওয়া হয়। তিনি পরে জানতে পারেন, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের কাছে কেউ একজন আপত্তি তুলেছিল যে “গোলামের ছেলেকে নেওয়া কি আমাদের ঠিক হবে কিনা”। জেনারেল এরশাদ তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে আলোচনা না করে এই সিদ্ধান্ত নিতে চাননি। তবে পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে অনুমতি আসার পর তাকে নতুন করে যোগদানের চিঠি দেওয়া হয়। আব্দুল্লাহিল আমান আযমী দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন যে তার বাবা জেনারেল এরশাদ বা অন্য কারো কাছে তার ছেলের জন্য তদবির করেছিলেন, কারণ গোলাম আযম তদবিরে বিশ্বাস করতেন না এবং নিজের ছেলের জন্য এরশাদের কাছে যাওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব তার ছিল না। তিনি নিজের যোগ্যতা বলেই সুযোগ পেয়েছিলেন বলে দাবি করেন।
সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষণের সময়ও তার বাবার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে তাকে তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। যখন তাকে সর্বোচ্চ পদ ‘ব্যাটালিয়ন সিনিয়র আন্ডার অফিসার’ (বিএসইউও) বানানোর সময় আসে, তখনও তীব্র আপত্তি ওঠে। এই সময় “আওয়ামী পরিবারের সন্তান দুই একজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার” আপত্তি করে বলেন, “গোলাম আজমের ছেলেকে বানানো যাবে না”। তবে, একাডেমির কমান্ডেন্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুস সালাম (পরে মেজর জেনারেল, যিনি পরে আওয়ামী লীগের এমপিও হয়েছিলেন) তখন তার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। তিনি বলেন যে তাদের কাজ হলো ক্যাডেটকে তার নিজের অর্জনের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা, তার বাবার কারণে তার অর্জন থেকে তাকে বঞ্চিত করার জন্য তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। একইভাবে, কমিশনের আগে ‘সোর্ড অফ অনার’-এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সময়েও তার বাবাকে নিয়ে আপত্তি এসেছিল। আব্দুল্লাহিল আমান আযমী তার সামরিক জীবনে একাধিক ক্ষেত্রে তার বাবার পরিচয়ের কারণে এই ধরনের কঠোর রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, কিন্তু তার দাবি অনুযায়ী, নিজস্ব মেধা ও যোগ্যতাবলেই তিনি সামরিক জীবনের সর্বোচ্চ সম্মানগুলো অর্জন করতে পেরেছিলেন।