গত মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সেনাসদরে অফিসারদের একটি স্টাডি পিরিয়ডের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-এর কিছু মন্তব্য বাংলাদেশের বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। ওই মন্তব্যে তিনি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে কিছু সেনাকর্মকর্তার জন্য ‘ইনডেমনিটি’ (দায়মুক্তি) দাবি করার অঙ্গীকার করেছেন, যা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ও তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। জেনারেল ওয়াকারের এই মন্তব্য, এবং তার প্রতি উত্থাপিত মোস্তাফিজুর রহমানের প্রশ্নগুলো—উভয়ই শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে ঘটে যাওয়া গুরুতর অপরাধ, যেমন বিডিআর বিদ্রোহের হত্যাকাণ্ড এবং বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের খুন-গুমের ঘটনায় জড়িত সেনাকর্মকর্তাদের ভূমিকা এবং তাদের সম্ভাব্য বিচারিক পরিণতির আতঙ্ককে সামনে এনেছে।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার তার বক্তৃতায় অফিসারদের মনোবল রক্ষার তাগিদ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমাদের অফিসারদের প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে তা কল্পনা করতেও আমার কষ্ট হয়। আমাদের ব্রাদার অফিসারদের এই অপমানের মুখোমুখি হতে হবে আমরা এটা কিভাবে সহ্য করবো? তাদের দোষ কী? তারা যা করেছে তা নির্দেশেই করেছে। আমি এই বিষয়টি নিয়ে সবার কাছে গিয়েছি, কিন্তু কেউ শোনেনি। আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি; আমি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক দল যারা ক্ষমতায় আসবে তাদের কাছ থেকে এই অফিসারদের জন্য ইনডেমনিটি দাবি করব। ইনডিমিনিটি না পেয়ে আমি যাব না।”
এই মন্তব্যের মূল বিষয়বস্তু দুটি: ১. নির্দিষ্ট কিছু সেনাকর্মকর্তা আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো বা কারাবন্দী হওয়ার আশঙ্কা করছেন (প্রিজন ভ্যান)। ২. তাদের অপরাধের দায়মুক্তি দিতে হবে, কারণ তারা কেবল ‘নির্দেশ’ পালন করেছেন।
বিশেষজ্ঞ মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, সেনাপ্রধানের এই ‘ইনডেমনিটি’ দাবি কেবলই ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিচার থেকে তার ‘ব্রাদার অফিসারদের’ রক্ষা করার জন্য একটি খোলা হুমকি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের ইঙ্গিত। এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলেন যে, গত ১৫ বছরের ক্ষমতা কাঠামোয় সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য এমন কিছু কাজ করেছেন, যার জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ‘নির্দেশেই করা হয়েছে’ (did was on orders) এই যুক্তি আন্তর্জাতিক আইন এবং সামরিক বিধানেও সবসময় ধোপে টেকে না, বিশেষ করে যখন সেই নির্দেশ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন বা রাষ্ট্রদ্রোহের দিকে নিয়ে যায়।
মোস্তাফিজুর রহমান সেনাপ্রধানের এই মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন, যা গত ১৫ বছরের দুঃশাসনের সময় সামরিক বাহিনীর নীরব ভূমিকা এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজনকে নির্দেশ করে:
মোস্তাফিজুর রহমান প্রশ্ন তোলেন: “২৫ শে ফেব্রুয়ারী ২০০৯ সালে আপনার এই ব্রাদার অফিসারদের প্রতি ফিলিংস কই ছিলো? তখনতো আপানি ২৫০ জন যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত সৈনিক নিয়ে আপনার আপার কথায় তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে যান নি।“
২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। মোস্তাফিজুর রহমানের প্রশ্নটি স্পষ্ট: যখন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের জীবন বিপন্ন হলো, তখন বর্তমান সেনাপ্রধান (সেই সময়ের অবস্থান অনুযায়ী) এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কেন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারেননি বা নেননি? একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর কমান্ড কাঠামো এবং অপারেশনাল সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সেনা কর্মকর্তারা কেন বিদ্রোহের মুখে অসহায়ভাবে নিহত হলেন? এই ট্র্যাজেডিটি এখনও সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে একটি গভীর ক্ষত হিসেবে রয়ে গেছে, এবং এই ঘটনার তদন্তে অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। দৈনিক আমার দেশসহ বিরোধী ঘরানার গণমাধ্যমগুলোতে তখন থেকেই অভিযোগ ছিল যে, ওই বিদ্রোহের নেপথ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর কিছু অংশেরও নীরব ভূমিকা ছিল।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও প্রশ্ন করেন: “
আপনার মন কান্দে নাই যখন মেজর জাহেদ, সিনহা এদের মারা হইল?“
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ড (২০২০) এবং মেজর জাহেদ হোসেনের মতো অন্যান্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা রহস্যজনক মৃত্যুগুলোও সামরিক বাহিনীর ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এসব ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান দেখা যায়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রেই সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক যোগসাজশের অভিযোগ ওঠে। সেনাপ্রধান যখন তার ‘ব্রাদার অফিসারদের’ জন্য ইনডেমনিটি দাবি করেন, তখন এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া অফিসারদের প্রতি তার সেই একই সংবেদনশীলতা কোথায় ছিল? এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ইনডেমনিটির দাবি কেবল সেই অফিসারদের জন্য, যারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করেছেন।
মোস্তাফিজুর রহমান তাপস মামলায় পাঁচজন কর্মকর্তাকে জেলে ভরা ও অনেককে গুম করার প্রসঙ্গ টেনে প্রশ্ন করেন: “
আপনি কই ছিলেন যখন তাপস মামলায় ৫ অফিসার, আর বাকি অনেক মিথ্যা মামলায় অফিসারদের জেলে ভরলো? কিছু গুম করলো?”
গত ১৫ বছরের শাসনামলে তথাকথিত সামরিক অভ্যুত্থানের অভিযোগে অনেক সেনাকর্মকর্তাকে আটক, জেল এবং পরবর্তীতে গুমের শিকার হতে হয়েছে। (দৈনিক আমার দেশ তখন থেকেই এসব ঘটনায় সামরিক ও রাজনৈতিক যোগসাজশের অভিযোগ করে আসছিল)। এই মামলাগুলোর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যখন সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলে বা সরকারের নির্দেশে বহু নিরপরাধ কর্মকর্তা মিথ্যা মামলার শিকার হলেন বা গুম হয়ে গেলেন, তখন সেনাপ্রধানের (তৎকালীন কর্মকর্তা) ভূমিকা নিয়ে মোস্তাফিজুর রহমানের প্রশ্ন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার প্রশ্নটি এক অর্থে সামরিক নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়:
ক্ষমতাসীন দলের নির্দেশে অপরাধ ও অবিচার হলে নীরব থাকা হবে, আর এখন যখন নিজেরা বিচারের মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তখন ‘ইনডেমনিটি’র হুমকি দেওয়া হচ্ছে?
মোস্তাফিজুর রহমানের চূড়ান্ত প্রশ্নটি ছিল জেনারেল ওয়াকারের মন্তব্যের সবচেয়ে বিতর্কিত অংশটিকে লক্ষ্য করে:
“আর এখন আপনি হুমকি দেন যে সর্বশক্তি দিয়ে নিশ্চিত করবেন যে আগামী সরকার খুনিদের ইনডেমনিটি দেয়?“
ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি আইন হলো কোনো অপরাধ সংঘটনের পর অপরাধীকে বিচার থেকে রক্ষা করার আইনি প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ইনডেমনিটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পরে আনা হয়েছিল। সেনাপ্রধানের এই দাবি পরোক্ষভাবে নির্দেশ করে যে, তার সুরক্ষা চাওয়া অফিসাররা গুরুতর অপরাধে (সম্ভবত খুন, গুম, মিথ্যা মামলা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড) জড়িত থাকতে পারেন, যা শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে বিরোধী মতকে দমনে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহারের ফলাফল।
জেনারেল ওয়াকারের এই ‘ইনডেমনিটি’র দাবি মূলত একটি সামরিক অভ্যুত্থান বা ক্ষমতা দখলের হুমকির সমতুল্য বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তিনি কার্যত ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এই বার্তা দিচ্ছেন যে, যদি সামরিক বাহিনীর ‘নির্দেশ পালনকারী’ সদস্যরা বিচারের মুখোমুখি হন, তবে সামরিক বাহিনী নীরব থাকবে না। এটি কেবল সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না, বরং দেশের বেসামরিক শাসন এবং আইনের শাসনের প্রতিও একটি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। মোস্তাফিজুর রহমানের প্রশ্নগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের ধারণাটি ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সুবিধাবাদী রূপ নিচ্ছে—যা দেশের গণতন্ত্রের জন্য এক গভীর অশনিসংকেত।