গাজার ত্রাণযুদ্ধ, আল-রাশিদ সড়কে একটি যাত্রা: পর্ব ১ - দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ
নোটিশ:
শিরোনামঃ
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা, ফেব্রুয়ারিতে ভোট ঢাবির আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের তিন বছরের ডিনস অ্যাওয়ার্ড প্রদান ঢাবি নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের নবীন ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের বরণ ও বিদায় অনুষ্ঠান শেকৃবি কৃষিবিদদের ৩ দফা দাবি নিয়ে আগারগাঁও ব্লকেড মাথার পেছনে গুলির চিহ্ন, রক্তে ভেসে থাকা বুক: ট্রাইব্যুনালে বাবার সাক্ষ্য তিন দফা দাবিতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটডাউন, পরীক্ষা স্থগিত গ্রিনল্যান্ডকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র-ডেনমার্কে নতুন কূটনৈতিক উত্তেজনা স্পেনে বুনোলে ৮০তম টোমাটিনা উৎসব, ১২০ টন টমেটো ছোড়াছুড়িতে মেতে উঠলেন ২২ হাজার মানুষ শেরপুরে নারীর সামর্থ্য উন্নয়ন ও জলবায়ু অভিযোজন প্রযুক্তি নিয়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত

গাজার ত্রাণযুদ্ধ, আল-রাশিদ সড়কে একটি যাত্রা: পর্ব ১

মারাম হুমায়েদ, আল জাজিরা
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৮ জুলাই, ২০২৫
  • ১৬৪ বার দেখা হয়েছে

গাজা শহর

সম্প্রতি, জীবনে প্রথমবার, গাজার ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা সেই বিশাল, ব্যাকুল জনতার ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হল আমার।

আমার নিজের এলাকা দেইর আল-বালাহতে এ দৃশ্য দেখা যায় না। তবে মাঝে মাঝে পরিবারের লোকজনকে দেখতে গাজার উত্তরের দিকে যেতে হয়।

সেই এক সফরে, উপকূলঘেঁষা আল-রাশিদ সড়কে এমন কিছু দেখলাম—যা আমার মনে গা-ছমছমে অস্বস্তি জাগিয়ে দিল, যুদ্ধবিরতির যত আলোচনা চলছে, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে। যদি এই যুদ্ধবিরতিতেও ত্রাণ সংকট দূর না হয়?

এই সংকটটাই হামাসকে বাধ্য করেছে প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিতে পরিবর্তনের দাবি তুলতে—
তারা চায় ত্রাণ সরবরাহের নিয়মে পরিবর্তন, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF)–এর অবসান। কারণ, এই GHF কেন্দ্রের সামনেই প্রতিদিন বহু মানুষ ত্রাণের অপেক্ষায় প্রাণ হারাচ্ছে, ইসরায়েলি গুলিতে।

আল-রাশিদ সড়কে যাত্রা

গত মার্চে ইসরায়েল যখন সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেয়, তখন থেকেই উত্তরের দিকে যাওয়া আমাদের জন্য একটা ঝুঁকির খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিকল্পনা নয়—কখন যাব, তা ঠিক করি ইসরায়েলি বিমান হামলার শব্দ শুনে।
রাতের ঘুমের আগে যদি মনে করি পরদিন যাব, সকালবেলা যদি বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনি—তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত বাতিল।

আবার যদি সকালে কিছুটা নীরবতা পাই, তখন তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ি। কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়। জামাকাপড়, খাবার, জরুরি কাগজপত্র ব্যাগে ভরে নিই। একটাই ভয় বুকের ভেতর কাঁপে— যদি হঠাৎ ট্যাংক উঠে আসে রাস্তায়, আর আমাদের আটকে ফেলে উত্তরে।

ঈদুল আজহার প্রথম দিন, ৬ জুন, আমার পরিবারকে না দেখে তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে।ইসরায়েলের স্থল অভিযানের নাম “অপারেশন গিডিয়নের রথ”—তখন চলছে চরম তাণ্ডব। আমি আর আমার স্বামী তাই স্থির করেছিলাম, রয়ে যাই নিজেদের আশ্রয়ে।

কিন্তু একটা সময় গিয়ে, পরিবারের টান ভয়কে হারিয়ে দিল। আর আমাদের মেয়ে বানিয়াস তো আরও জেদ ধরেছিল—“আমি ঈদে দাদুকে দেখতেই যাব।” শেষমেশ বেরিয়ে পড়লাম আমরা।

এই যাত্রাগুলো আমাদের চোখে স্পষ্ট করে দেয়—গাজার এখনকার ভেঙে পড়া পরিবহন ব্যবস্থা কতটা দুর্বল।

যে পথ একসময় ব্যক্তিগত গাড়িতে মাত্র বিশ মিনিটে পার হতো—দেইর আল-বালাহ থেকে গাজার শহরের আমার পরিবারের বাড়ি পর্যন্ত— এখন সেই একই পথ পাড়ি দিতে হয় বহু স্টপেজে, দীর্ঘ হাঁটায়, আর ভাগ্যনির্ভর যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করে।

গাজা শহরে পৌঁছাতে আমাদের প্রথমে করতে হয় তিনটা “ভেতরের যাত্রা”— আজ-জাওয়াইদা, দেইর আল-বালাহ আর নুসাইরাত—এমন আশপাশের এলাকাগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্র দূরত্বে ছোট ছোট ট্রিপ, যেমন: ভাগ করে নেওয়া গাধার গাড়িতে, অথবা পুরোনো কোনো গাড়িতে, যার পেছনে খোলা ট্রলি বেঁধে রাখা।

এসব যানবাহনের জন্য কখনো কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। গাধার গাড়িতে গাদাগাদি করে ১২ জন পর্যন্ত উঠে পড়ে, আর গাড়ি-ট্রলি মিলে গাড়িতে ৬ জন আর ট্রলিতে ১০–১২ জন।

এরপর আসে “বাইরের যাত্রা”—একটা জেলা থেকে আরেক জেলায়, বড় ঝুঁকি নিয়ে, খণ্ডবিখণ্ড রাস্তায়— সেখানে আবার তুক-তুকের মতো ছোট যানবাহনে গাদাগাদি করে ১০ জন বা তার বেশি মানুষ।

জানুয়ারির যুদ্ধবিরতির পর (যা মার্চে ইসরায়েল নিজেই ভেঙে দিয়েছে), ইসরায়েল এখন কেবল পায়ে হেঁটে চলা বা গরুর/গাধার গাড়ি ছাড়া আর কোনো যান চলাচলের অনুমতি দেয় না।

যাত্রাটা কখনো এক ঘণ্টা, কখনো দুই ঘণ্টা—সবটাই নির্ভর করে রাস্তায় কত গর্ত, কত ধ্বংস।

এই দুর্বিষহ সফর এখন আমার নতুন স্বাভাবিক।
আর যদি সঙ্গে থাকে বাচ্চারা—তাহলে সেই ক্লান্তি যেন দ্বিগুণ।

Maram Humaid in Gaza with her husband and children

মারাম হুমায়েদ, তাঁর স্বামী মোহান্নাদ, কন্যা বানিয়াস এবং পুত্র ইয়াস সহ

যাদের বলে “ত্রাণ অন্বেষী”

উত্তরের শেষ দুটি সফরে আমি সামনে থেকে দেখেছি সেই মানুষগুলোকে—যাদের এখন সংবাদে বলা হয় “ত্রাণ অন্বেষী”।

শব্দটা যতটা কঠিন শুনতে লাগে, বাস্তবে তাদের জীবনটা তার চেয়েও ভয়াবহ। এই দৃশ্য যেন আরেকটা পৃথিবীর চিত্র।

৬ জুন, বানিয়াসের ঈদের ইচ্ছা পূরণ করতে আমরা সন্ধ্যার একটু আগেই একটা তুক-তুকে উঠে বসেছিলাম।

রাস্তার পশ্চিম পাশে, যেটা গাজার মানুষ বলে “আল-শারী আল-জাদীদ” বা “নতুন রাস্তা”— সেই ৭ কিলোমিটার লম্বা নেৎজারিম করিডোর জুড়ে দেখি—বালির টিলায় শত শত মানুষ বসে আছে, কেউ আগুন জ্বালিয়েছে, চারপাশে জড়ো হয়ে আছে।

সেই সড়কটা যেন একটা মৃত ভূখণ্ড—ধ্বংস, ধুলা আর ক্ষুধার ছায়া ঘেরা।

আমি মোবাইল বের করে ভিডিও করতে শুরু করি। গাড়িতে অন্য যাত্রীরা বললো—এই মানুষগুলো এখানে এসেছে ত্রাণ ট্রাক থামিয়ে যা পাওয়া যায় তা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য।

তাদের কেউ আবার অপেক্ষা করছে পাশের সালাহ আল-দিন সড়কে অবস্থিত মার্কিন পরিচালিত “GHF” বিতরণ পয়েন্টে, যেটা ভোরে খুলবে।

গাড়িতে তখন গম্ভীর আলোচনা চলছিল সেই মার্কিন ত্রাণ পয়েন্ট নিয়ে— “এটাই তো এত মৃত্যুর কারণ।” মানুষ বলছিল—এই সাহায্য ব্যবস্থা জীবনকে পরিণত করেছে এক লটারিতে, আর মর্যাদা হয়ে গেছে সেই লটারির সবচেয়ে বড় পরাজিত।

আমি তখন চুপ। এতদিন খবর পড়ে বা ভিডিও দেখে যতটা বুঝেছি, বাস্তবে সামনে দাঁড়িয়ে দেখা—তা একেবারেই আলাদা।

হঠাৎ বানিয়াস জিজ্ঞেস করল— “মা, এরা এখানে কি করছে? ক্যাম্পিং করছে নাকি?”

আহ, এই শিশুটি এখনো তার গোলাপি স্বপ্নের জগতে বাস করে।

আমি নিশ্চুপ হয়ে যাই। আমার চোখের সামনে ভাসছিল—কালো ধোঁয়া, ধুলায় ভরা রাস্তা, কঙ্কালসার শরীর, খালি চোখ।

আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি।

পুরুষ আর কিশোরেরা যাচ্ছিল—কেউ পিঠে ব্যাগ, কেউ খালি সাদা বস্তা নিয়ে, যেভাবে পারা যায় কিছু জোগাড় করার আশায়।
কার্ডবোর্ডের বাক্স কেউ নেয় না—ওগুলো বহন করা ভারি।

এই মানুষগুলো হেঁটে এসেছে গাজার নানা প্রান্ত থেকে—
রাতভর, কখনো সকাল ৪টা, ৫টা, আবার কখনো ৬টা পর্যন্ত ত্রাণের অপেক্ষায় বসে থাকে।
তাদের আশঙ্কা, GHF-এ ঢোকার আগেই ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালিয়ে মেরে ফেলবে।

সংবাদে লেখা থাকে—এই মানুষগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে যা পাওয়া যায় তা কুড়াতে,
এক বিশৃঙ্খল দৌড়ে, যেখানে শক্তিশালী মানুষ দুর্বলকে ঠেলে ফেলে রেখে দেয়।

এই মানুষগুলো জানে—এই পথ মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
তবুও তারা যায়।

কারণ?
ক্ষুধা তাদের ছাড়ে না।
আর বিকল্প নেই—হয় না খেয়ে মরো, না হয় বাঁচার চেষ্টায় মরো।

আমরা যখন গাজা শহরে পৌঁছলাম, চারপাশে শুধু ধুলো, ধ্বংসস্তূপ আর থমথমে বাতাস।

তুক-তুক চলছিল বিধ্বস্ত রাস্তা ধরে।
প্রতিটি ধাক্কা যেন আমাদের পিঠে চাবুকের মতো লাগছিল। এক যাত্রী হেসে বলল,
“এই যাত্রায় সবার কোমর আর পিঠের যেন আস্ত থাকবে না!”

চারপাশের নীরবতা ভেঙে দিল বানিয়াস—আমাদের গোলাপি দুনিয়ার ছোট্ট সাংবাদিক:
“মা, বাবা! দেখো তো, চাঁদটা কত সুন্দর! একদম পূর্ণ।

“আমার মনে হয় খালা মায়ার চাঁদের পাশে আছেন,” বলল সে।
আমার বোন, যিনি যুদ্ধ শুরুর পর মিশর হয়ে কাতারে চলে যান।

আমরা জিজ্ঞেস করি—“তুমি সেটা কীভাবে বুঝলে?”

সে বলে—“খালা তো বলেছিলেন, তাঁর নামের মানে—‘চাঁদের পাশে থাকা তারা’। দেখো না, ঠিক ওখানেই!”

আমরা ক্লান্ত শরীরেও একচিলতে হাসি ছড়িয়ে দিই।
গাড়ির অন্য যাত্রীরাও মন দিয়ে শুনছিল বানিয়াসের স্বপ্নময় কথা।

“বাবা, আমরা কখন স্কুলে জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়বো?”
—সে আবার জানতে চায়—
“আমি চাঁদ-তারাদের ব্যাপারে জানবো।”

আমরা তখনও উত্তর দিতে পারিনি।
ঠিক তখনই গাড়ি থামে—আমরা পৌঁছে গেছি।

আরেকটি দীর্ঘ, দুঃসহ দিনের শেষ হয়।

পরের পর্ব: গাজার ত্রাণযুদ্ধ, আল-রাশিদ সড়কে একটি যাত্রা: পর্ব ২

—————-

মূল আর্টিকেল: https://www.aljazeera.com/news/2025/7/7/gazas-starving-men-and-women-chase-trucks-willing-to-die-to-feed-families

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT