ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও ছাত্র রাজনীতির ভেতরে ইসলামি ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা গোপনে ছাত্রলীগে সক্রিয় হয়ে নির্যাতন, নিপীড়নের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে বিস্ফোরক অভিযোগ করেছেন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (ডাকসু)–এর আহ্বায়ক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আবদুল কাদের। রোববার রাতে দেওয়া একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি এসব দাবি করেন, যেটি ঘিরে ছাত্ররাজনীতির অন্দরমহলে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। শিবির মূলত নিজেকে ছাত্রলীগ প্রমাণ করার দায় থেকে এসব করে এবং আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সুযোগে অনেক সময় ছাত্রলীগের নিপীড়ন-নির্যাতনের অংশীদারও হয়ে ওঠে।
আবদুল কাদেরের দাবি, ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি রাতে বিজয় একাত্তর হলে শাহরিয়াদ নামের এক শিক্ষার্থীকে রাতভর মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে নেতৃত্বে ছিলেন মাজেদুর রহমান, যিনি একই এলাকার এবং মাদ্রাসায় পড়াশোনা করার সুবাদে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ক্যাম্পাসে এসে তিনি ভয়ংকর নিপীড়ক ও নির্যাতক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
তাছাড়া, ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটির দপ্তর সম্পাদক মুসাদ্দিক বিল্লাহও শিবিরের সঙ্গী ছিলেন। যদিও তিনি জামাত পরিবারের সদস্য, পদ-পদবী পাওয়ার জন্য কট্টর ছাত্রলীগের মতনই আচরণ করতেন। এ ছাড়া জসীমউদ্দীন হলে আফজালুন নাঈমের গেস্টরুমে দুর্ব্যবহার ও নিপীড়নের কারণে হলের ছাত্ররা অতিষ্ঠ ছিল। তিনি বর্তমানে জামাত–শিবিরের আইকন শিশির মুনিরের বিশেষ সহকারী।
মুজিব হলে ২০১৬-১৭ সেশনের ইলিয়াস হোসাইন মিছিল-মিটিংয়ে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ ফোর্স করতেন। তিনি হল ক্যান্ডিডেট ও ছাত্রলীগের পদও পেয়েছিলেন। ৫ আগস্টের পর তিনি শিবিরের বড় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং শিবিরের ইমামদের সঙ্গে চলাফেরা করেন।
২০১৭ সালে মুহাম্মদ মুহসীন হলে ইসলামিক পেজে লাইক দেওয়ার কারণে পাঁচ শিক্ষার্থীকে শিবির সন্দেহে রাতভর নির্যাতন করে রক্তাক্ত করে হলে থেকে বের করে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় ১৩ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের হয়। মুহসীন হলের সাবেক ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মো. শাহাদাত হোসেন ভুক্তভোগীর মোবাইল চেক করে অতর্কিত হামলা চালান। তিনি শিবির হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মামলার পর শিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম একজন পোস্টকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে শাহাদাতকে যেন এসবের সঙ্গে না জড়ানো হয়, সে জন্য তদবির করেন।
ছাত্রলীগের হল ক্যান্ডিডেটরা শিবিরের স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসেবে কাজ করে। তারা ছাত্রলীগের মতোই মিছিল-মিটিংয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক নিয়ে যেত এবং গণরুম, গেস্টরুমে আটকে রাখত। তাদের উদ্দেশ্য একটাই, পদ পাওয়া। এই ক্যান্ডিডেটদের পেছনে গুপ্ত শিবির সদস্যরা তেলবাজি ও চাটুকারিতে অনন্য দক্ষতা দেখাত। তারা প্রয়োজনীয় সময় তথ্য দিয়ে এবং প্রোগ্রামের তাগিদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের জোর করে হাজির করাতো।
এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন জহু হলে ২১-২২ সেশনের হাসানুল বান্না, যিনি ৫ আগস্টের পরে শিবির সদস্য সম্মলনে অংশ নিয়ে নিজেকে সদস্য হিসেবে প্রকাশ করেন এবং বর্তমানে জহু হল শাখার বড় নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। এফ রহমান হলের ১৮-১৯ সেশনের রায়হান উদ্দিনও ৫ আগস্টের পরে শিবিরের বড় নেতা হিসেবে সক্রিয় হয়েছেন। তিনি ছাত্রলীগের একজন অ্যাকটিভ কর্মী ছিলেন, কিন্তু এখন শিবিরের হয়ে কাজ করেন।
৫ আগস্টের পরে হলে হলে শিবিরের ছেলেরা ব্যাচ প্রতিনিধি ও শৃঙ্খলা কমিটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারা অনলাইনে ভোটাভুটি করে নিজেদের লোকজনকে নির্বাচিত করে এবং ছায়া প্রশাসন হিসেবে কাজ করে। এই ব্যাচ প্রতিনিধিরাই ছাত্রলীগের নামের তালিকা তৈরি করে নিজেদের সাথীদের বাইরে রাখে।
একাত্তর হলের হাসান সাঈদী এবং এফ রহমানের তানভীর হাসান শান্তের মতো শিবির সংশ্লিষ্টরা নানা অপকর্ম চালিয়ে আসলেও আইনের আওতায় আসেনি। সাঈদী বহুবার গ্রেপ্তার ও বহিষ্কৃত হলেও শিবিরের গুণগান গেয়ে আসছেন। তিনি ব্যবসায়ী অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলেও দ্রুত জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাকে আটক করে। এর পর শিবিরের ঢাবি সভাপতি সাদিক কায়েম তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য তদবির করেন।
আবদুল কাদের বলেন, ৫ আগস্টের পর মামলা করা ব্যক্তিদের মধ্যে শিবিরের সাদিক কায়েমের তদবিরের কারণে অনেক আসামির নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। তিনি জানান, “জুলাইয়ের অঙ্গীকার রক্ষা করা যায়নি, সবাই দলীয় মানুষজনকে বাঁচাতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের মুক্তি দিয়েছে।”
শিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আবদুল কাদেরের কথাগুলো ভিত্তিহীন, আমি নির্দোষদের হয়রানি বন্ধ করতে চেষ্টা করেছি।”