টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট-এর একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ একটি ডিজিটাল পুলিশি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছিল, যেখানে ভিন্নমত ও মানবাধিকার দমন করতে নজরদারির একটি জটিল ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। প্রায় এক বছর ধরে পরিচালিত এই গবেষণায় পাবলিক রেকর্ড, বাণিজ্য নথি, ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই নজরদারি ব্যবস্থার বিবর্তন, কাঠামো এবং প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কিভাবে সরকার তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম ও আইন ব্যবহার করেছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৩ সালের তিনটি নির্বাচনে জয়লাভের জন্য ডিজিটাল নজরদারির পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, যা প্রতিটি নির্বাচনেই ব্যাপক কারচুপির অভিযোগের সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রধান বিরোধী দলগুলো, যেমন বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলাম, সেই সঙ্গে ভিন্নমতাবলম্বী, ছাত্র ও অ্যাক্টিভিস্টরা নিবিড় ও আক্রমণাত্মক নজরদারির শিকার হয়েছেন। এই নজরদারি প্রায়শই নির্বিচার গ্রেফতার, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিকে নিয়ে গেছে।
প্রতিবেদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, কীভাবে সরকার জনগণের ওপর নজরদারি চালানোর জন্য সাধারণ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করেছে। তদন্তে এমন অনেক ঘটনা সামনে এসেছে যেখানে রাইড শেয়ারিং, ফুড ডেলিভারি, ই-কমার্স, গেমস এবং অন্যান্য স্থানীয় কন্টেন্ট প্ল্যাটফর্মের মতো জনপ্রিয় অ্যাপের মাধ্যমে ম্যালওয়্যার ছড়ানো হয়েছে। এই ম্যালওয়্যার ব্যবহারকারীদের ডিভাইসে ইনস্টল হওয়ার পর ব্যক্তিগত তথ্য, যোগাযোগ এবং অন্যান্য সংবেদনশীল ডেটা সংগ্রহ করতে সক্ষম ছিল। এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করে জনগণের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কার্যকলাপের ওপর নজরদারি করা হতো, যা তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো জনগণের ওপর নজরদারি চালাতে বিভিন্ন ধরনের স্পাইওয়্যার এবং নজরদারি প্রযুক্তি ক্রয় করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে যে, এই নজরদারি প্রযুক্তিগুলো ভিন্নমত ও মুক্ত সাংবাদিকতাকে দমনের জন্য একটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সরকার সমালোচকদের চিহ্নিত করতে, তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে এবং তাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে এই ডিজিটাল সরঞ্জাম ব্যবহার করেছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিশেষ করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (RAB), Wi-Fi এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক ইন্টারসেপশনের পাশাপাশি সিগন্যাল জ্যামিংয়ের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই কৌশলগুলো সাংবাদিকদের উপর নজরদারি করতে, তাদের ডিভাইস থেকে তথ্য বের করতে এবং তাদের কাজে বাধা দিতে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও, বিভিন্ন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে সরকার তার সমালোচক এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে, যা তাদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দিয়েছে।
টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট-এর এই প্রতিবেদন স্পষ্ট করে দেখায় যে, শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ একটি গভীর নজরদারি রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখা এবং বিরোধীদের নির্মূল করার জন্য প্রযুক্তিকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা মানবাধিকার, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মৌলিক নীতিগুলোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই নজরদারি ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং তত্ত্বাবধানের অভাব ছিল, যা এটিকে একটি ‘ডিজিটাল পুলিশি রাষ্ট্রে’ পরিণত করেছে।