রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টম হাউসের লকার থেকে স্বর্ণ উধাও হওয়ার ঘটনা দুই বছর ধরে নানা জল্পনার জন্ম দিয়েছিল। শুরুতে ঘটনাটিকে সরল চুরির মামলা হিসেবে গণ্য করা হলেও, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ভিন্ন এক চিত্র। চুরি নয়, বরং কাস্টমস কর্মকর্তাদের পরিকল্পিত আত্মসাতের মাধ্যমে প্রায় ৬১ দশমিক ৮১৫ কেজি স্বর্ণ উধাও হয়েছে।
প্রথমে ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন কাস্টমস হাউসের এয়ারপোর্ট প্রিভেন্টিভ টিমের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন। তিনি জানান, ৫৫ কেজি স্বর্ণ চুরি গেছে। কিন্তু তদন্ত যত এগোয়, ততই স্পষ্ট হয় যে বিষয়টি সরল চুরির নয়, বরং সুপরিকল্পিত আত্মসাৎ।
এনবিআরের তদন্ত কমিটি, যার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন সদস্য ফারজানা আফরোজ (বর্তমানে আপিল ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট), দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখেন—গুদাম কর্মকর্তা চারজন ও চারজন সিপাহি মিলে এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন। অভিযুক্ত কর্মকর্তারা হলেন সাইদুল ইসলাম সাহেদ, শহিদুল ইসলাম, আকরাম শেখ ও মাসুম রানা। আর সিপাহিরা হলেন রেজাউল করিম, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন ও নিয়ামত হাওলাদার। তাদের সকলেই বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক এবং কারাগারে রয়েছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়—২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাজেয়াপ্ত হওয়া এবং দীর্ঘদিন বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও তা করা হয়নি। এর মধ্যে ৩৪ দশমিক ৫১৯ কেজি বাজেয়াপ্ত স্বর্ণ ও ২৭ দশমিক ২৪১ কেজি বিচারাধীন স্বর্ণ আত্মসাৎ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে পাঠানো হয়েছে বলে রেজিস্ট্রারে জাল সিল বসানো হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে, এসব আসলে কখনোই বাংলাদেশ ব্যাংকে যায়নি।
তদন্তে দেখা যায়, দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে ভুয়া নথি তৈরি করে স্বর্ণ গায়েব করলেও হিসাবের খাতায় সব ঠিকঠাক আছে বলে দেখান। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তারা স্বর্ণ সরিয়ে রাখেন এবং বিষয়টি জানাজানি হলে নতুন উৎস থেকে জোগাড় করে ফের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করেন। ২০২৩ সালের আগস্টে দায়িত্ব পরিবর্তনের সময় নতুন কর্মকর্তারা যখন লকার মিলিয়ে দেখেন, তখন প্রথমবার বিষয়টি সামনে আসে। এরপর এনবিআরের নির্দেশে ৪৮ সদস্যের কমিটি ইনভেন্টরি করলে প্রায় ৬২ কেজি স্বর্ণ অনুপস্থিত ধরা পড়ে।
তদন্তে আরও বলা হয়েছে, এই আত্মসাতের ঘটনায় চার সিপাহিরও গাফিলতি ছিল। তাদের ওপর গুদামে প্রবেশ ও বহির্গমনের নজরদারির দায়িত্ব থাকলেও তারা তা পালন করেননি। যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে এত বড় পরিমাণ স্বর্ণ লোপাট হওয়া সম্ভব ছিল না।
এনবিআরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “চুরির ক্ষেত্রে সাধারণত স্বর্ণ বা স্বর্ণালংকার হঠাৎ করে উধাও হয়, কিন্তু এখানে দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পিতভাবে বাজেয়াপ্ত ও বিচারাধীন স্বর্ণ আত্মসাৎ করা হয়েছে।” তাই এটি নিছক চুরির ঘটনা নয়, বরং এক ভয়াবহ আত্মসাতের কাণ্ড।
ঘটনার তদন্তে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ইতোমধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে। দুদক এনবিআর ও পিবিআই-এর প্রতিবেদন হাতে নিয়ে আত্মসাতের মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সবশেষে বলা যায়, বিমানবন্দরের মতো একটি কৌশলগত স্থানে থাকা মূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদ এভাবে আত্মসাতের শিকার হওয়া কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতাই নয়, বরং রাষ্ট্রের জন্য বড় এক সতর্কবার্তা। তদন্ত কমিটি জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা পুনরাবৃত্তি না ঘটে।