বাংলাদেশের প্রধান আম উৎপাদনকারী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে এখন চলছে পাকা আমের ভরা মৌসুম। আমবাগান আর বাজার জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে কর্মচাঞ্চল্য। মাঠের পর মাঠ আম গাছ থেকে আম নামানোর দৃশ্যে সরগরম। আর বাজারগুলোয় চলছে জমজমাট বেচাকেনা। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো — এতো ভালো ফলনের পরও মুখে হাসি নেই চাষিদের। কারণ, উৎপাদন খরচের তুলনায় আমের দাম অনেক কম, আর এ নিয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন জেলার হাজারো আমচাষি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট, ভোলাহাট, রহনপুরসহ বড় বড় আমবাজারগুলোতে দেখা গেছে বাহারি জাতের আমের সমারোহ। গোপালভোগ ইতোমধ্যেই শেষ। বর্তমানে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে খিরসাপাত, ল্যাংড়া, ফজলি, আম্রপালি, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, গুটি জাতসহ নানা ধরনের আম। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যাপারিরা এসেছেন আম কিনতে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে আমের দরদাম আর কেনাবেচা। তবে এবার আমের দাম গত বছরের তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে আম বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৪ হাজার টাকা মণ দরে। অথচ গত মৌসুমে এই সময়েই একেক জাতের আম বিক্রি হতো প্রায় দ্বিগুণ দামে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে আম নামার শুরুর দিকে বৈরী আবহাওয়া, ঈদের লম্বা ছুটি, ব্যাংক ও পরিবহন বন্ধ ছিল। সঙ্গে অতিরিক্ত গরমে একসঙ্গে বহু জাতের আম পাকতে শুরু করে। ফলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে যায় এবং সেই তুলনায় চাহিদা কমে যায়। এর প্রভাব পড়ে আমের দামে। তবে গত সপ্তাহের তুলনায় কিছুটা দাম বাড়লেও, চাষিদের মুখে স্বস্তি নেই।
চাষিরা জানান, এবার আম বাগান পরিচর্যায় সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, সেচ আর শ্রমিকের খরচ বেড়েছে। উৎপাদনের খরচ উঠবে কিনা তা নিয়েই শঙ্কায় দিন পার করছেন তারা। খিরসাপাত আমের শুরুতে দাম ছিল মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকা মণ, যেখানে গত বছর একই সময় ছিল ২ হাজার ৯০০ টাকা। এখন এ আম বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা মণ দরে। কিন্তু এখন আর বাগানে তেমন আম নেই। গাছের ৫০ মণের জায়গায় রয়েছে মাত্র ৫ মণ। ফলে এখন দাম বাড়লেও লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে বৃষ্টির কারণে আমে দাগ আর ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে আমের মানও নষ্ট হচ্ছে। চাষিরা জানান, একদিকে দামের সমস্যা, অন্যদিকে আবহাওয়ার বৈরী আচরণ—সব মিলিয়ে এবারের আমের মৌসুমটা বড়ই হতাশাজনক। এরফান নামে এক চাষি জানান, ‘ঈদের ছুটি আর বৃষ্টি—দুটোই একসঙ্গে এসে আমের ক্ষতি করেছে। এখন যে কয়টা আম আছে, সেগুলোও দাগ পড়া আর ফাটল ধরা। লাভ তো দূরের কথা, খরচই উঠবে কি না জানি না।’
চাষি সবুর আলী বলেন, ‘বৃষ্টির আগে ল্যাংড়া আম ছিল খুব সুন্দর। এখন বৃষ্টিতে দাগ পড়েছে, ফেটে গেছে। এই অবস্থায় বাজারেও দাম পাওয়া যাচ্ছে না।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. ইয়াছিন আলী বলেন, ‘আম পচনশীল ফল। এবার ঈদের আগে অতিরিক্ত গরমে আম দ্রুত পেকে গেছে। ঈদের লম্বা ছুটিতে ঢাকাসহ বড় শহরের ভোক্তারা গ্রামে চলে যাওয়ায় চাহিদা কমে যায়। এতে আমের বাজার পড়ে যায়। তবে বর্তমানে আবার বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দামও বাড়ছে। তবে চাষিদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হলে আরও উদ্যোগ প্রয়োজন।’
তিনি আরও জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর জমিতে আম বাগান হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৫৯০ টন। যা গত বছরের ৩ লাখ ৪৮ হাজার টনের তুলনায় অনেক বেশি।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশে আমের উৎপাদন বাড়ছে ঠিকই। কিন্তু চাষিদের টিকিয়ে রাখতে হলে আম রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। নইলে প্রতি বছর এমন দুরবস্থা দেখে হতাশায় দিন কাটাতে হবে চাষিদের।