ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার এক বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে গত ২৯ জুন বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি) -এর BFS ২২২ ব্যাচের শিক্ষার্থী ফাতেমা আনোয়ারা ইশা (এশা আনোয়ার)-এর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে এটি আত্মহত্যা মনে হলেও, এই ঘটনার পেছনে উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের চরম অবহেলা এবং নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন। এশার মৃত্যুর এক মাস আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততাই এই অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলে অভিযোগ উঠেছে।
এশার মৃত্যুর ঠিক এক মাস আগে, অর্থাৎ ২৯ মে, একটি ঘটনা ঘটে। একাধিক নারী শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই ডিপার্টমেন্টের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট শফিকুল ইসলাম তাদের ল্যাপটপ থেকে ব্যক্তিগত ছবি, তথ্য ও অন্যান্য গোপনীয় জিনিস হাতিয়ে নিতেন। এশা ২৯ মে একটি সফটওয়্যার ইন্সটল করার জন্য তার ল্যাপটপ শফিকুলের কাছে রেখে যান। পরবর্তীতে তিনি মোবাইল থেকে তার সোশ্যাল মিডিয়া ও ই-মেইল চেক করে দেখতে পান যে নতুন ডিভাইস থেকে তাতে লগইন করা হয়েছে।
এশা ও তার বন্ধুরা যখন শফিকুলকে হাতেনাতে ধরেন, তখন তারা দেখতে পান যে সে অন্য এক ছাত্রীর ল্যাপটপ থেকে ফাইল ট্রান্সফার করছে। ভিডিও প্রমাণসহ অন্যান্য তথ্য নিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেন। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে উল্টো ছাত্রীদেরকেই দোষারোপ করা হয়। সিএসই ডিপার্টমেন্টের ডিন বলেন, “আমার কাছে যদি টাকার বস্তা থাকলে আমি কি সেটা খুলে দিয়ে আসব?” অর্থাৎ, তিনি মেয়েদেরকেই নিজেদের ব্যক্তিগত জিনিস ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের কাছে রেখে আসার জন্য দোষ দেন।
যদিও প্রমাণের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শফিকুলকে চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু করার কথা বলেছিল, কিন্তু ঈদের ছুটির পর তাকে স্বপদে বহাল থাকতে দেখা যায়। প্রশাসনকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা ছাত্রীদেরকে মানবিক হতে এবং অভিযুক্তের পরিবারের কথা চিন্তা করতে বলে। এশা তখন জীবিত ছিলেন এবং এই ঘটনায় হতাশ হয়ে একটি ভার্সিটি গ্রুপের মন্তব্যে লেখেন, “আমার কাছে ইতিমধ্যে খবর এসেছে যে তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে না। উল্টো তারা আমাকে এবং বাকি ভিক্টিমদেরকে দোষ দিচ্ছে যে কেন আমরা নিজেদের ল্যাপটপ তাকে দিয়েছি।” মৃত্যুর আগে তিনি তার এক বান্ধবীকে বলেছিলেন, “এই দেশে মেয়ে মানুষ হওয়া পাপ, ভিক্টিম জাস্টিস কী পাবে উল্টা হ্যারাস করে ছেড়ে দিবে।”
এশার মৃত্যুর পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো কথা বলেনি। বরং জুলাইয়ের ১৭ তারিখে অনুষ্ঠিত একটি মিটিংয়ে সিএসই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক বিমন বড়ুয়া বলেন, “আমরা তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাইনি”। প্রক্টরও বলেন, আইডি-তে লগইন করলে সমস্যা কী? এটা গুরুতর কোনো বিষয়ই না। অর্থাৎ, তারা অভিযুক্তকে আড়াল করতে গিয়ে মৃত মেয়েটাকেই দোষারোপ করে।
এশার মৃত্যুর পর ১০ জন ভিক্টিম শফিকুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে, ঘটনার তিন মাস পর, ৬ আগস্ট শফিকুলকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু এই বিলম্বিত বিচার এশার মৃত্যুর দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এড়াতে পারে না। শফিকুলের বাইরেও আইটি-এর হেড সিদ্ধার্ত সুন্দর মন্ডলের বিরুদ্ধে একাধিক মেয়ে অভিযোগ করে যে, সেই লোক রাতের বেলা ছাত্রীদের কাছে ফটোশুটের ছবি চায় এবং অপ্রয়োজনে টেক্সট করে।
এই পুরো ঘটনাটি বিইউএফটি-এর নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। এটি কেবল এশার একার ঘটনা নয়, বরং একটি অকার্যকর বিচার ব্যবস্থা এবং কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততার প্রতিফলন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য এক নিরাপত্তাহীন পরিবেশ তৈরি করেছে। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো মেয়েকে এশার মতো হারিয়ে যেতে না হয়।