ঢাকার আকাশে তখন সন্ধ্যা নামছে। জাতীয় স্টেডিয়ামের চারপাশে মানুষের ঢল। কারো হাতে পতাকা, কারো মুখে রং, কারো চোখে স্বপ্ন। একটিই অপেক্ষা — ‘ফুটবল আবার ফিরছে।’
৫৫ মাস! দীর্ঘ প্রায় চার বছর সাত মাস এই স্টেডিয়াম ছিল আন্তর্জাতিক ফুটবলের জন্য নীরব। আর আজ, সেই নীরবতা ভাঙতে হাজির হামজা চৌধুরী। ইংল্যান্ডে জন্ম, লেস্টার সিটির হয়ে প্রিমিয়ার লিগ খেলা তারকার আজ অভিষেক ঢাকার মাটিতে। দেশের মানুষের সেই চেনা স্লোগান ফিরে পাওয়ার দিন।
মাঠের গল্পটা শুরু হয় এক কর্নার থেকে। ম্যাচের মাত্র ৬ মিনিট। কর্নার নিতে এগিয়ে যান অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া। ভুটানের রক্ষণে তখন টানটান চাপ। সেই কর্নার বল উড়ল জালে, তবে জামালের পায়ে নয়। কর্নার থেকে নিখুঁত হেডে গোল করলেন হামজা চৌধুরী। স্টেডিয়াম যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল। ‘বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!’ — গ্যালারি গর্জে উঠল। ৫৫ মাস ধরে জমে থাকা একটানা চিৎকার যেন এক মুহূর্তে মুক্তি পেল।
হামজার জন্যও এই গোল বিশেষ। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ৫৭ ম্যাচ খেলে মাত্র এক গোল। আর ঢাকায় ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ম্যাচেই প্রথম গোল। জাতীয় দলের জার্সিতে গোলের পর হামজার দু’হাত আকাশের দিকে। পাশে ছুটে এসে জামাল, ফাহমিদুল, রাকিবদের আলিঙ্গন। এ যেন বহুদিন পর ঘরের মাঠে ফেরার উল্লাস।
বাংলাদেশ ২ : ০ ভুটান
গোলদাতা : হামজা চৌধুরী (৬’), সোহেল রানা (৪৯’)
দর্শক : প্রায় ১৫ হাজার
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : হামজা চৌধুরী
ভুটানের হারানো ছন্দ আর বাংলাদেশি আগ্রাসন। গোল হজম করে ভুটান কিছুটা হাল ছেড়ে দেয়। বাংলাদেশ তখন গতি, আগ্রাসন আর আক্রমণে দুর্দান্ত। ৩৫ মিনিটে আবারও জামালের সুযোগ। তাজ উদ্দিনের দুর্দান্ত ক্রস থেকে বল পেয়েছিলেন জামাল। গোল নিশ্চিত ভেবেছিল সবাই। কিন্তু ভুটানের গোলকিপার জাংপো আবারও নায়ক। ঠেকিয়ে দেন সেই শট।
গ্যালারিতে তখন দর্শকরা ‘ওই ওই ওই…’ বলে ওঠে।
বিরতির পর বদলে গেল খেলাধুলার ভাষা। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই কোচ কাবরেরা একসঙ্গে তিন বদল। মাঠ ছাড়েন হামজা, জামাল ও কাজেম। নামেন মোরসালিন, হৃদয় আর ইব্রাহিম। গতি কমেনি। বরং মাঠ আরও খোলামেলা। ৪৯ মিনিটে সোহেল রানার দূরপাল্লার শট। ২৫ গজ দূর থেকে বাঁ পায়ের মাটি কামড়া শটে বল ভুটানের জালে।
গ্যালারিতে উল্লাস। কেউ পতাকা উড়ায়, কেউ লাফ দেয়, কেউ মোবাইলের ক্যামেরা অন করে সেলফি তোলে।
স্টেডিয়ামের গেটেও ছিল ফুটবল যুদ্ধ। মাঠের উন্মাদনা মাঠের বাইরেও। হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামের পাশের গেটে দর্শকদের ঠেলাঠেলি। অনেকেই টিকিট হাতে থেকেও ঢুকতে পারেননি। কেউ ধৈর্য হারিয়ে গেট ভেঙে ঢুকে পড়েন।
ম্যাচের মাঝখানে ঘটে এক সিনেমার মতো ঘটনা। এক দর্শক গ্যালারির বেড়া টপকে মাঠে নেমে ছুটে গেলেন হামজা চৌধুরীর কাছে। ছবি তুলতে চাইলেন। নিরাপত্তাকর্মীরা ধরে ফেললেও সেই মুহূর্ত গ্যালারিতে সিনেমার দৃশ্যের মতো উল্লাস।
শেষ দিকে দারুণ নাটক। ম্যাচের একেবারে শেষ মুহূর্তে ভুটানও হঠাৎ গোলের সামনে। জিগমে নামগিয়াল একদম ডান প্রান্ত থেকে শট নেন। গোলবারের সামনে শুধু মিতুল। মুহূর্তেই বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে দারুণ সেভ করেন মিতুল মারমা। গ্যালারিতে নিশ্বাস বন্ধ করা থমথমে মুহূর্ত।
শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে স্কোরবোর্ড : বাংলাদেশ ২ : ভুটান ০।
২১ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামে ছিল প্রায় ১৫ হাজার দর্শক। সে এক রকম মেলা। কেউ পতাকা বেঁধেছেন মাথায়, কেউ হামজার পোস্টার নিয়ে, কেউ ফোন হাতে সেলফি।
ম্যাচ শেষে ফাহমিদুল গ্যালারির প্রেসবক্সের কাছে দাঁড়িয়ে বাবামায়ের সঙ্গে দেখা করলেন। অনেকে হামজার সঙ্গে সেলফির জন্য অপেক্ষা। প্রেসিডেন্ট বক্সে বসে ছিলেন শমিত সোম, যিনি সেদিনই ভোরে ঢাকায় পা রেখেছেন।
এই জয় কেবল দুই গোলের নয়। ৫৫ মাসের হাহাকার শেষে মাঠে ফিরে পাওয়া এক উল্লাসের জয়। গ্যালারির গর্জন, মাঠের আগ্রাসন, দর্শকের আবেগ মিলিয়ে বাংলাদেশ ফুটবলের নতুন দিনের শুরু।
আজকের জয় পুরোনো দিনের স্মৃতি ফিরিয়ে আনল। আর জানিয়ে দিল, বাংলাদেশ ফুটবলের সেই দিনগুলো আবারও ফিরতে চলেছে।
আগামী ১০ জুন সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচ রয়েছে। এই জয়ে দল অনেকটাই চাঙা এবং আত্মবিশ্বাসী। কোচ কাবরেরা জানালেন, কিছু জায়গায় সমন্বয়ের অভাব থাকলেও দল ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরছে।