কোলকাতার টলিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের পাশে প্রতিদিন দেখা যায় কয়েকজন তরুণকে। তাঁদের সামনে সাজানো থাকে ছোট ছোট কাঁচের শিশি, নানা রঙের তরল, নানা ঘ্রাণের সমাহার। এরা বিক্রি করেন আতর। শহরের ভিড়ের মধ্যে এই ঘ্রাণ যেন এক টুকরো শান্তি এনে দেয় পথচলতি মানুষের মনে। মৈনাক দত্ত সেই তরুণদের একজন। বন্ধুদের সঙ্গে মিলে তিনি শুরু করেছেন এই ছোট উদ্যোগ—“সোঁদা, বাঙালির গন্ধ অভিযান।”
কিন্তু সাম্প্রতিক এক অভিজ্ঞতা মৈনাকের হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, “আজ আমার প্রিয় শহর কোলকাতায় আমায় বাংলাদেশি বলে গালি দিলেন এক অচেনা মানুষ।”
ঘটনাটা ঘটেছিল ঠিক সেদিন, যখন মৈনাক প্রতিদিনের মতো টলিগঞ্জ মেট্রোর কাছে আতর বিক্রি করছিলেন। ষাটোর্ধ্ব এক বাঙালি ভদ্রলোক তাঁর পণ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ বলে বসেন, “তোমরা বাংলাদেশ থেকে এসে তো ভালোই তো ব্যবসা ফেঁদে বসেছো, আমাদের জায়গা সব দখল করে নষ্ট করে দিচ্ছ।” বিস্মিত হয়ে মৈনাক জিজ্ঞেস করেন, “আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি—এমন কথা বললেন কেন?” জবাব আসে, “এসব আতর তো বাংলাদেশি মুসলিমরা ব্যবহার করে বেশি। তাই তুমিও নিশ্চয় ওদিক থেকে এসেছো।”
এই সংলাপে যোগ দেন পাশের আরেকজন। তার মন্তব্য, “বাংলাতে দিদি যতদিন আছে, এইসব বাড়াবাড়ি চলতেই থাকবে।” তারপর তারা চলে যান। আর মৈনাক দাঁড়িয়ে থাকেন স্তব্ধ হয়ে, গলা আটকে যায় তাঁর।
মৈনাক তাঁর পোস্টে স্মরণ করেছেন বাবার কথা। বাবা কোনো নেতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তি নন। সারাজীবন কষ্ট করে, শ্রম দিয়ে, শহরের উন্নয়নে ছোট্ট অবদান রেখেছেন। কিন্তু সেই শ্রমের উত্তরাধিকার বহনকারী ছেলেকে একদিন হঠাৎ “বাংলাদেশি” বলে অপমান করা হলো। এর পেছনে যুক্তি নয়, আছে এক রাজনৈতিক মানসিকতা, যা দিনে দিনে বিস্তার লাভ করছে।
ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিসরে ‘বাংলাদেশি’ শব্দটি কেবল ভৌগোলিক নির্দেশনা নয়, বরং একটি গালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেসব মানুষকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি সমাজ থেকে আলাদা করতে চায়, তাদের ওপর এই লেবেল চাপিয়ে দেওয়া হয়। একসময় এর নিশানায় ছিল মুসলমানরা। তাঁদের দেশবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী বা বাংলাদেশি বলে অপমান করা হতো। কিন্তু এখন লক্ষ্যবস্তুতে এসেছে বাংলাভাষী মানুষও, এমনকি তাঁরা হিন্দু হলেও।
এই প্রবণতার পেছনে রয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের বহু বছরের অভিবাসন-রাজনীতি এবং পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তেজনা। শাসক দলের বিরুদ্ধে বারবার ওঠা অভিযোগ—বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির খাতিরে। এই অভিযোগ থেকেই জন্ম নেয় সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ, আর সেই সন্দেহ একসময় রূপ নেয় বৈরিতায়।
ভারতের সমাজ-রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদের প্রভাব নতুন নয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর আক্রমণাত্মক প্রকাশ আরও বেড়েছে। গোরক্ষা, লভ জিহাদ, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC)—এসব ইস্যুতে মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছেন। তাঁদের নাগরিকত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ তোলা হয়েছে।
কিন্তু মৈনাকের ঘটনার মতো উদাহরণ প্রমাণ করে, এই উগ্রতার শিকার হচ্ছেন বাংলাভাষীরাও। কারণ, রাজনৈতিক প্রচারণায় যেভাবে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ’ বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে, তাতে ভাষার পরিচয়ই হয়ে দাঁড়াচ্ছে সন্দেহের কারণ।
প্রশ্ন আসতে পারে—আতর বিক্রি করা কেন এমন অভিযোগের জন্ম দিল? আসলে আতরকে এখানে দেখা হলো একধরনের সাংস্কৃতিক চিহ্ন হিসেবে। উগ্রবাদীরা এটিকে মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ধরে নিলেন, আতর বিক্রি মানেই বাংলাদেশি মুসলিমের ব্যবসা। অথচ আতরের ইতিহাস বহুধাবিভক্ত—ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আতর ব্যবহার করে আসছে।
মৈনাকের অভিজ্ঞতা কোনো একক ঘটনা নয়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে এমন বহু কাহিনি, যেখানে সাধারণ মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে কেবল তাদের ভাষা বা সংস্কৃতির কারণে। শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে অবিশ্বাসের বিষ। অথচ বাংলার ইতিহাসই হলো সহাবস্থানের ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, বঙ্কিম থেকে শরৎচন্দ্র—সবাই মিলে নির্মাণ করেছেন এক বহুত্ববাদী ঐতিহ্য।
কিন্তু আজ সেই ঐতিহ্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে মানুষকে ভাঙা হচ্ছে ‘আমরা’ আর ‘ওরা’-তে। যেখানে “ওরা” বলতে বোঝানো হচ্ছে বাংলাদেশি, অনুপ্রবেশকারী, বহিরাগত।
অপমান সত্ত্বেও ভেঙে পড়েননি মৈনাক। তার কথায়, “আমরা মনে করি সুগন্ধি আতর মানুষের মনে ভালবাসার সঞ্চার ঘটায়। সুগন্ধের কোনো হিন্দু-মুসলিম হয় না।” তাই তিনি আবারও পরদিন টলিগঞ্জ মেট্রোর পাশে দাঁড়ান আতরের বাক্স নিয়ে।
এটাই হয়তো সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ। ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসার সুগন্ধ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। ভাঙনের বিপরীতে ঐক্যের আহ্বান। আতরের শিশি হয়ে উঠেছে প্রতীক—মানুষকে আলাদা নয়, কাছে টানার প্রতীক।
মৈনাকের অভিজ্ঞতা সামনে আনে এক ভয়ঙ্কর প্রশ্ন—আজকের ভারতে কি কেবল ধর্ম নয়, ভাষার পরিচয়ও হয়ে উঠছে আক্রমণের কারণ? বাঙালি হয়ে ওঠা মানেই কি বাংলাদেশি বলে গালি খাওয়া? এই প্রবণতা যদি চলতে থাকে, তবে সমাজে বিভেদের রেখা আরও গভীর হবে।
এমন প্রেক্ষাপটে দরকার সহমর্মিতা, সহাবস্থান আর সংলাপ। নাগরিকত্ব নয়, মানুষকে চেনার একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত মানবতা। মৈনাক দত্ত সেই মানবতার পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন। তাঁর ছোট্ট আতরের দোকান হয়তো কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের মঞ্চ নয়, কিন্তু প্রতিদিনের প্রতিরোধের এক জীবন্ত প্রতীক।