আলেপ উদ্দিন -এর নির্যাতন কেবল শারীরিকই ছিল না, এটি ছিল মানসিক ও সামাজিকভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার একটি পদ্ধতি। নির্যাতনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, মিথ্যা মামলার শিকার হওয়া এবং কারাগারে কাটানো দিনের করুণ চিত্র উঠে এসেছে এই লেখায়।
২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। বিকালের দিকে আমার বান্ধবী আমাকে ফোন দিল। কাঁদতে কাঁদতে জানালো কিছু সাদা পোশাকের লোক ওর স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে। ও একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। বিচারবহির্ভূত গুম-খুন, অত্যাচার তখন দেশের নিত্যদিনের বাস্তবতা। দাঁড়ি-টুপি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়া, দ্বীনের দাওয়াত দেয়া – এগুলোর যে কোনো একটাই যে কাউকে “জঙ্গি” তকমা দিয়ে গায়েব করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমার বান্ধবীর স্বামী একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম, তাকে গুম করার জন্য তাদের আলাদা কোনো কারণের দরকার ছিল না।
বিপদে পড়া বান্ধবীর পাশে দাঁড়ানো নিজের দায়িত্ব মনে হল। কিন্তু আমার কোন ধারণাই ছিল না, আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে।
আমার ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলার ৩-৪ দিন পরেই টের পেলাম, আমাদের প্রতিটি কথা, প্রতিটি বার্তা, প্রতিটি পদক্ষেপ নজরদারির আওতায় চলে গেছে। ফোনকল, মেসেজ—সবকিছুর ওপর কেউ নজর রাখছে। যেদিন আমি ওর বাসায় গেলাম সেদিনই র্যাবের তিনজন সদস্য ওদের বাসায় এসে আমার ব্যক্তিগত তথ্য, বাসার ঠিকানা এবং ফোন নম্বর নিয়ে গেলো।
২৮ অক্টোবর সকালে একটি অজানা নম্বর থেকে ফোন আসলো। ফোনের ওপাশ থেকে বললো, আমার বান্ধবী আর তার স্বামীর ব্যাপারে প্রশ্ন করার জন্য বাসার সামনে তিনজন র্যাব সদস্য এসেছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম দুটো ল্যান্ড ক্রুজার এবং প্রায় ১০-১৫টা বাইক আমাদের পুরো বাসা ঘিরে রেখেছে। আতঙ্কিত হয়ে আমি আমার স্বামীকে ডাকলাম।
আমি তখন আমার দেড় বছরের মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহাকে খাওয়াচ্ছি। আমার প্রথম সন্তান মারা যাবার পর আমার এই মেয়ের জন্ম। সে আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। ওকে জোর করে নামিয়ে বাসার খাদিমার কোলে দিয়ে আমি বাসা থেকে বের হলাম। নিচে নামতেই ওরা প্রথমে আমাদের ফোন ছিনিয়ে নিলো। চোখ বেঁধে এলাকার লোকজনের সামনেই গাড়িতে তুললো।
এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হল তাদের “আয়নাঘর”-এ। চোখের বাঁধন খুলে দেখি আমাকে একটি ছোট, অন্ধকার সেলে রেখেছে। আমাকে ওরা হাতকড়া পরিয়ে লোহার শিকের সঙ্গে বেঁধে রাখে। হিজাব খুলে দাঁড় করিয়ে রাখে।
৩ বাই ৫ ফুটের সেই সংকীর্ণ সেলের ভেতরে ছিল একটি ছোট টয়লেট আর সামনেই বসানো ছিল সিসিটিভি ক্যামেরা। আমি জানতাম না আমার স্বামী কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে। আমি জানতাম না আমাদের কি অভিযোগে এভাবে ধরে আনা হয়েছে। এই বদ্ধ সেলে বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের মত আমার ৪৮ ঘণ্টা কাটে।
র্যাব-১১ এর এসপি আলেপ উদ্দিন ও আরেক কর্মকর্তা মশিউর রহমান ছিল ইন্টারোগেশনের দায়িত্বে। নিয়ম অনুযায়ী নারীদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় নারী প্রতিনিধি থাকা বাধ্যতামূলক, কিন্তু আলেপ উদ্দিন সেই নিয়মের তোয়াক্কা করত না। সে বরাবরই নারীদের গায়ে হাত তোলার ব্যাপারে অতি উৎসাহী ছিল।
ইন্টারোগেশন রুম ছিল প্রচণ্ড গুমোট আর সাউন্ডপ্রুফ। কিছুক্ষণ চারপাশে তাকালেই মাথা ভারী হয়ে আসত, চোখ কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যেত। মনে হত, আমি ধীরে ধীরে হিপনোটাইজ হয়ে যাচ্ছি।
তারা শুধু মানসিক চাপ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। বারবার শারীরিকভাবে নির্যাতন চালিয়েছিল। আমি নারী বন্দী হওয়া সত্ত্বেও এসপি আলেপ উদ্দীন নিজেই নির্যাতনের নেতৃত্ব দিত। তার জন্য কোনো নিয়মের বাধ্যবাধকতা ছিল না—সে আইন নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করত।
এই ৪৮ ঘণ্টার পর শুরু হয় নতুন নাটক। আমাকে সাজানো অস্ত্র ও বইয়ের সামনে বসিয়ে মিডিয়ার সামনে “জঙ্গি” বলে প্রচার করা হয়। এরপর থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং আমার নামে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়।
পুলিশি রিমান্ড শেষে আলেপ উদ্দীন ৫ দিনের নতুন রিমান্ডের আবেদন করে। রিমান্ডের সময়ে আমাকে ধর্ষণের হুমকি দেয়, আমার দেড় বছরের বাচ্চাকে হত্যা করার হুমকি দেয়, স্বামীকে চিরতরে হারানোর ভয় দেখায়। একাধিক ছিন্নভিন্ন শরীরের ছবি দেখিয়ে আমাকে মিথ্যা স্বীকারোক্তিতে বাধ্য করার চেষ্টা চালায়। শেষমেষ, ভয়াবহ নির্যাতনের পর আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
কারাগারেও নিপীড়ন চালু থাকে। জানানো হয়, আমি মাসে মাত্র একবার, মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারব।
কিন্তু ১৫ দিন যেতে না যেতেই আলেপ উদ্দীন আবার আমাকে রিমান্ডে ডেকে পাঠায়। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের অসম্মান করায় সে পৈশাচিক আনন্দ পেত। একবার আমি প্রতিবাদ করতেই সে বলেছিল, “আমার নাম কসাই! আমি কী করতে পারি, তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”
শেষমেষ দীর্ঘ ৭ মাস অনেক কষ্টের পর আমার জামিন হয়। কিন্তু এখানেই দুঃস্বপ্ন শেষ হয়নি। র্যাব ও ডিবি অফিস থেকে ডেকে পাঠানো, প্রতিমাসে কোর্টে হাজিরা দেয়া, জামিন এক্সটেনশনের ঝামেলা—এসবের মাধ্যমে আমাকে হয়রানি করা হতো।
আমার উপর যে জুলুম হল, আমার সন্তানের উপর যে জুলুম হল এটা তো আমি কখনো ভুলব না। আমি দোয়া করি এদেশে এই ভয়াবহ অবিচার আর কখনো ফিরে না আসুক, আর কারো উপর এরকম জুলুম না হোক। আর বদ দোয়া করি সেই সব জালেমদের বিরুদ্ধে যারা এই অত্যাচার করেছে, অত্যাচারে মদদ দিয়েছে। আলেপ উদ্দীন -এর মত লোকেদের উপর আল্লাহর গজব পড়ুক, তাদের পরিবারের উপর আল্লাহর গজব পড়ুক।
আমীন।