রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ভারতের সম্পৃক্ততা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠছে। ২০১৭ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির মাধ্যমে ভারত প্রকল্পে সরাসরি প্রবেশাধিকার পায়।
চুক্তিগুলোর মূল বিষয়: পারমাণবিক নিরাপত্তা, বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ, তথ্য বিনিময়, যৌথ প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সহযোগিতা।
বিশ্লেষকদের শঙ্কা: এর আড়ালে ভারত প্রকল্পের নকশা, ফুয়েল টেকনোলজি, কুল্যান্ট পাম্প ও নিরাপত্তা কাঠামোর মতো স্পর্শকাতর তথ্য পাচ্ছে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: এসব চুক্তি ভারতের পারমাণবিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে এবং বাংলাদেশের অবকাঠামোকে ভারতীয় প্রভাববলয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
চুক্তিগুলো প্রাথমিকভাবে ২০ বছরের জন্য কার্যকর, বাতিল করতে হলে এক বছরের লিখিত নোটিশ প্রয়োজন। তবে তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তার শর্তাবলি কার্যকর থাকবে অনির্দিষ্টকাল।
প্রকল্পের প্রশাসনিক কাঠামো নিয়েও বিস্তর বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
ড. জাহেদুল হাসানের নিয়োগ: রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছাড়াই তাকে এনপিসিবিএলের এমডি করা হয়, যা সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ ও কমিশন সার্ভিস বিধিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন।
গোপন প্রক্রিয়া: যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দেওয়া, সিনিয়র প্রকৌশলীকে সরানো এবং বিজ্ঞপ্তি এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে একমাত্র জাহেদুল হাসানই যোগ্য হন।
আইনের অপব্যবহার: তার পিআরএল (অবসর-উত্তর ছুটি) রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছাড়াই স্থগিত করা হয়—যা প্রশাসনিক ইতিহাসে নজিরবিহীন।
তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক গুরুতর অভিযোগ:
প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার দুর্নীতি ও অর্থপাচার
বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা
প্রকল্প পরিচালনায় ব্যাপক অনিয়ম
বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে অপারেশন-রক্ষণাবেক্ষণ হস্তান্তরের প্রচেষ্টা
আইএইএর পরামর্শ উপেক্ষা করে আগেভাগে ফুয়েল লোডের চেষ্টা
তিনি অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেকে “যোগ্য ও সৎ” বলে দাবি করেছেন।
ড. জাহেদুলের সঙ্গে মিলে অলক চক্রবর্তী প্রকল্পে একক প্রভাব বিস্তার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তি: ২০২২ ও ২০২৪ সালে তিনি ভারতীয় বিশেষজ্ঞ নিয়োগে ভূমিকা রাখেন। তবে এসব বিশেষজ্ঞের কার্যকর কোনো অবদান ছিল না; অথচ তাদের বেতন-ভাতা, বাসস্থান ও অন্যান্য খরচ বাবদ রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় হয়েছে।
বিদেশ সফর: ২০১২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তিনি ৩২ বার বিদেশ সফর করেছেন। অনেক সফরে স্পন্সরের নাম অস্পষ্ট রাখা হয়। ভারতে এক বছরের দীর্ঘ সফর নিয়েও বিতর্ক আছে।
দুর্নীতি ও প্রভাব:
ভারতীয় সাব-কন্ট্রাক্টর পাহাড়পুর কুলিং টাওয়ার–এর জন্য নিয়মিত লবিং
প্রকল্পের স্ক্র্যাপ ব্যবসা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ
আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় উৎকোচ গ্রহণ
ভারতীয় কোম্পানির কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে বিশেষ তদবির
অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তিনি শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই অবৈধভাবে নিয়োগ পান এবং পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন।
অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও বিদেশি স্বার্থে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। যেমন গৌতম চন্দ্র রায়—তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ। তবে তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, যোগ্যতার ভিত্তিতেই তার নিয়োগ হয়েছে।
রূপপুর প্রকল্পে এখন তিনটি বড় ধরনের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে:
ভারতের কৌশলগত প্রভাব ও তথ্য পাচার
সিন্ডিকেটের অবৈধ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক অনিয়ম
দুর্নীতি, অর্থপাচার ও বিদেশি স্বার্থরক্ষা
এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের এই প্রকল্প দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার কারণে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রকল্পের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় অবিলম্বে স্বচ্ছ তদন্ত, আইনানুগ পদক্ষেপ এবং ভারতীয় প্রভাববলয় থেকে মুক্তির কৌশল গ্রহণ করা জরুরি।