বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নটি বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্লেষক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর গভীর উদ্বেগের কারণ। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আসার পর থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন এবং নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বারবার আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সম্প্রতি ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানারকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা পশ্চিমা লেন্সে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর মারাত্মক দুর্বলতাকেই তুলে ধরে।
ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল উত্তর প্রদেশের কানপুরের রাওয়াতপুর গ্রামে, যেখানে মিলাদ-উন-নবী (বারা ওয়াফাত) উপলক্ষে একটি শোভাযাত্রার সময় ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা একটি আলোকসজ্জার ব্যানার স্থাপন করা হয়। ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থানীয় হিন্দু গোষ্ঠীগুলো এই ব্যানারের তীব্র আপত্তি জানায় এবং এটিকে একটি ‘নতুন প্রথা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে, যা তাদের মতে, হিন্দু উৎসবের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহৃত এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করছে। এরপর থেকেই উত্তেজনা শুরু হয়। হিন্দু গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ আসে যে মুসলিম যুবকরা তাদের ধর্মীয় পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে এবং মুসলিম পক্ষ অভিযোগ করে যে তাদের ধর্মীয় ভাবাবেগ প্রকাশে উস্কানিহীন আগ্রাসন চালানো হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ব্যানারটি সরিয়ে নেয়।
তবে এই ঘটনাটি শুধু স্থানীয় সংঘর্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। কানপুরে ২৪ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর (প্রথম তথ্য বিবরণী) দায়ের করা হয়, যেখানে নয়জন নামধারী এবং ১৫ জন অজ্ঞাত ব্যক্তি ছিল। তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক শত্রুতা প্রচার এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়। পুলিশ যদিও স্পষ্ট করে জানায় যে মামলাটি কেবল স্লোগানের জন্য নয়, বরং শোভাযাত্রার রীতিনীতি পরিবর্তন এবং পোস্টার ছেঁড়ার অভিযোগে দায়ের করা হয়েছে, তবুও মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে এই পদক্ষেপটি ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় উত্তরপ্রদেশের বেরেলিতে একজন ইমাম শান্তিপূর্ণভাবে ঘরে ঘরে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ পোস্টার প্রদর্শনের আহ্বান জানান। খুব দ্রুতই এই প্রতিবাদ মহারাষ্ট্রের মুম্বাই, তেলেঙ্গানার হায়দ্রাবাদ এবং অন্যান্য রাজ্য পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
এই বিতর্কের সবচেয়ে নির্মম দিকটি তুলে ধরেছে মাকতুব মিডিয়া। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কানপুরের একটি স্থানীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ২১টিরও বেশি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে এবং প্রায় ১,৩০০ জনেরও বেশি মুসলিমকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই ব্যাপক সংখ্যক মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনা বিশ্লেষকদের কাছে ভারতের বিচার ব্যবস্থার পক্ষপাতিত্ব এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগের নির্দয়তা হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো মনে করে যে, শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় ভাবাবেগ প্রকাশ করা একটি মৌলিক মানবাধিকার। যখন সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সামান্যতম ধর্মীয় প্রকাশের জন্য এত বিশাল সংখ্যক নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে এবং গ্রেপ্তার করে, তখন তা স্পষ্টতই রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের ইঙ্গিত দেয়। AIMIM প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি যেমন দাবি করেছেন, “আইন সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদ দ্বারা সুরক্ষিত” এবং “আই লাভ মুহাম্মদ বলা কোনো অপরাধ নয়।” এর বিপরীতে, সরকারের দ্রুত এবং কঠোর প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে যে, ক্ষমতাসীন সরকার একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছে।
বিশ্লেষক এবং মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা এই ধরনের ঘটনাকে ভারতের তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ পরিচয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত বলে মনে করেন। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই পরিস্থিতি ভারতের অভ্যন্তরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নীরব দমন-পীড়নেরই বহিঃপ্রকাশ।
পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের কাছে এটি স্পষ্ট যে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী যখন তাদের ধর্মীয় স্লোগান (যেমন, #ILoveMahadev, #ILoveRam) দিয়ে পালটা প্রচার চালাচ্ছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনেও হিন্দু গোষ্ঠীগুলোর পালটা অনলাইন প্রচারণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু মুসলিমদের সামান্যতম ধর্মীয় অভিব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দমনের চেষ্টা করা হয়েছে। এই দ্বিমুখী নীতিই প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ধর্মীয় সমতার নীতি থেকে সরে এসে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাবাবেগকে প্রাধান্য দিচ্ছে। পশ্চিমী দেশগুলোতে ধর্মীয় ভাবাবেগ প্রকাশকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অংশ হিসেবে দেখা হয়। সেখানে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বা ‘আই লাভ জেসাস’ বলা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতে এই ধরনের একটি স্লোগানকে সাম্প্রদায়িক শত্রুতার কারণ হিসেবে দেখিয়ে ১,৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করাকে পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা বাকস্বাধীনতার ওপর সরাসরি আক্রমণ এবং ধর্মীয় ভীতি সৃষ্টির একটি কৌশল বলে মনে করেন।
এত বিপুল সংখ্যক মানুষের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার ঘটনাকে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা আইনের অপব্যবহার হিসেবে দেখেন। তাদের মতে, এই ধরনের গণমামলা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভয়ের মধ্যে রাখার এবং রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনের একটি কৌশল। এতে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়।
ভারতের এই ঘটনাটি পশ্চিমা বিশ্লেষকদের কাছে বিজেপি সরকারের ‘বিভাজনের রাজনীতি’র একটি উদাহরণ। তারা মনে করেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ক্রমাগত কোণঠাসা করে এবং তাদের ধর্মীয় প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে চিত্রিত করে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট নিশ্চিত করার একটি কৌশল হিসেবেই সরকার এই কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানারটি কেবল একটি স্লোগান ছিল না, এটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য একটি পরীক্ষা ছিল। এই পরীক্ষায় সরকার ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মম দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়ে প্রমাণ করেছে যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং স্বাধীনতা ভারতে ক্রমবর্ধমানভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পশ্চিমা লেন্সের মাধ্যমে এই নির্মমতাকে ‘গণতান্ত্রিক অবক্ষয়’ এবং ‘মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন’ হিসেবেই দেখা হয়, যা আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে ও মাকতুব মিডিয়া