সম্প্রতি ইরান তার পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করার জন্য ইসরায়েলের একটি প্রচেষ্টার মুখোমুখি হয়েছিল। এই ঘটনা ১২ দিনের জন্য উভয় দেশের মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষের জন্ম দেয়। এটি পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং আঞ্চলিক ক্ষমতার সংঘাতের এক ভয়াবহ পরিণতি স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে কোনো মুসলিম দেশকে পারমাণবিক শক্তি অর্জন থেকে থামানোর জন্য ইসরায়েলের এটি প্রথম চেষ্টা ছিল না। ১৯৮০-এর দশকে, ইসরায়েল ভারতের গোপন সহায়তায় পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। তবে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
পাকিস্তানের মতো অর্থনৈতিকভাবে উন্নত নয় এমন একটি দেশ কীভাবে পারমাণবিক কর্মসূচি গড়ে তুলল, যা তাকে ইসরায়েলের লক্ষবস্তুতে পরিণত করেছিল? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে স্নায়ুযুদ্ধের যুগে।
শুরুর কথা: “অ্যাটমস ফর পিস” কর্মসূচি
১৯৫৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাটমস ফর পিস’ কর্মসূচির অধীনে পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশন (Pakistan Atomic Energy Commission) প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল দেশগুলোকে বোমা তৈরি না করার শর্তে বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি বিকাশে সহায়তা দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ধীর করা।
এই কর্মসূচির আওতায় পাকিস্তান ৩৭ জন বিজ্ঞানীকে বিদেশে পাঠায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় পারমাণবিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে। ১৯৬১ সালের মধ্যে লাহোরে পাকিস্তানের নিজস্ব গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এর দুই বছর পর, ইসলামাবাদে এর রাজধানী কাছে একটি ছোট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও তৈরি হয়।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধ ও পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা
১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ওয়াশিংটন, যা ছিল ইসলামাবাদের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী, পাকিস্তানের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কারণ পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করে দুই দেশের মধ্যেকার চুক্তি লঙ্ঘন করেছিল। একই সময়ে, ভারতও গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি শুরু করেছিল।
পাকিস্তান তখন দুটি জরুরি প্রয়োজনের মুখে পড়ে: একটি নির্ভরযোগ্য মিত্র খুঁজে বের করা এবং নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করা। চীনের মতো মিত্র পেয়ে পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে মনোযোগ দেয়। তৎকালীন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো স্পষ্ট করে দেন যে, যদি ভারতের কাছে বোমা থাকে, তবে পাকিস্তানও একটি বোমা তৈরি করবে, এমনকি যদি এর জন্য ঘাস খেয়েও বাঁচতে হয়।
ভারতের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
১৯৭১ সালে ভারতের সঙ্গে আরেকটি যুদ্ধের পর পাকিস্তান তার পূর্ব অংশ (বর্তমানে বাংলাদেশ) হারায় 20। এর তিন বছর পর, ভারত তার প্রথম পারমাণবিক ডিভাইসের পরীক্ষা চালায়, যার নাম ছিল ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ 21। এই ডিভাইসটি যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দেওয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল, এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে যে এটি শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হবে।
পাকিস্তান এই পরীক্ষার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ভারতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানায় 23। কিন্তু তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেননি 24।
‘প্রজেক্ট ৭০৬’ এবং ডঃ এ কিউ খান
১৯৭২ সালে, জুলফিকার আলী ভুট্টো মুলতানে বিজ্ঞানী ও আমলাদের নিয়ে একটি গোপন বৈঠক করেন। এই বৈঠকে তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির শপথ নেন এবং এই গোপন উদ্যোগটির নাম দেওয়া হয় ‘প্রজেক্ট ৭০৬’—পাকিস্তানের নিজস্ব ম্যানহাটন প্রজেক্ট।
এই সময়ে, ড. আবদুল কাদির খান নামের একজন পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানী ইউরেনকো (URENCO) নামক একটি ইউরোপীয় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ভুট্টোকে তার সেবার প্রস্তাব দেন। এরপর তিনি নেদারল্যান্ডস থেকে চুরি করা সেন্ট্রিফিউজ নকশা নিয়ে পাকিস্তানে ফিরে আসেন এবং দেশে একটি সমান্তরাল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি শুরু করেন। এটি ছিল পাকিস্তানের পারমাণবিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। ভারতের পরীক্ষার পর পাকিস্তানকে যেকোনো ধরনের পারমাণবিক প্রযুক্তি অর্জন থেকে বিরত রাখার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু ড. খান ভুট্টোকে একটি ভিন্ন পথে সহায়তা করার প্রস্তাব দেন, যা ছিল উচ্চ-সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের পথ।
সরঞ্জাম কেনার জন্য ড. খান ফ্রন্ট কোম্পানিগুলোর একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন, যার মধ্যে একটিকে একটি মাখন কারখানার ছদ্মবেশে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই কর্মসূচির সৌন্দর্য ছিল যে, এটি ছোট ছোট যন্ত্রাংশ যা বহুমাত্রিক কাজে ব্যবহার করা যায় (যেমন ভ্যাকুয়াম ক্লিনার বা ওয়াশিং মেশিনের যন্ত্রাংশ) সেগুলো আমদানি করে দেশের ভেতরেই অস্ত্র তৈরি করতে পারতো।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং জিয়া উল হকের সমর্থন
১৯৭৭ সালে ভুট্টোকে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে ভুট্টোর উত্তরসূরি জেনারেল জিয়া উল হকের অধীনে ড. খানের প্রকল্পটি আরও বেশি সমর্থন ও অর্থায়ন পেতে শুরু করে।
১৯৭৯ সালে, ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এবং একটি জার্মান প্রামাণ্যচিত্র পাকিস্তানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ফাঁস করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নেয়নি 39। কারণ, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল এবং ইরানে শাহের পতন হয়েছিল 40। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে একটি অপরিহার্য আঞ্চলিক মিত্র হিসেবে দেখতে শুরু করে। এর ফলে পাকিস্তান এমন একটি অবস্থানে চলে আসে যেখানে তাদের কাছে বোমা আছে এমন একটি বিভ্রম তৈরি হয়, কিন্তু বাস্তবে বোমা ছিল না। এর মাধ্যমে পাকিস্তান একদিকে যেমন আমেরিকান সহায়তা পাচ্ছিল, তেমনি ভারতকে ভারসাম্যহীনও রাখছিল।
ইসরায়েল ও ভারতের গোপন অভিযান
১৯৭৯ সালে সিআইএ জানতে পারে যে, ইসরায়েল পাকিস্তানের কাহুতা পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর কথা ভাবছে। তবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু ১৯৮১ সালে ইসরায়েল ইরাকের পারমাণবিক চুল্লিতে বোমা হামলা চালায় এবং ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানের ওপর একটি প্রাক-আক্রমণের পরিকল্পনা করে।
১৯৭৪ সালের ইসলামিক সম্মেলন থেকে ইসরায়েল জানতে পেরেছিল যে, মুসলিম দেশগুলো গোপনে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে সমর্থন দিচ্ছে। ইসরায়েলের ভয় ছিল যে, একটি মুসলিম দেশ সফল হলে ভবিষ্যতে তা তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে এই ধরনের হামলা বিপজ্জনক হতে পারে।
১৯৮৩ সালে পাকিস্তান তার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি জনসমক্ষে আনে এবং একটি পারমাণবিক ডিভাইসের প্রথম ‘কোল্ড টেস্ট’ পরিচালনা করে। এর পরের বছর, ইসরায়েল এবং ভারত পাকিস্তানের স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানোর জন্য একটি যৌথ পরিকল্পনা করে। এই যৌথ অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন কাহুতা’। এই পরিকল্পনায় ভারতীয় বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলোকে কাশ্মীরের ওপর দিয়ে রাডার ফাঁকি দিয়ে উড়ে যাওয়ার কথা ছিল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই পরিকল্পনায় সম্মতি দিলেও পরে তা বাতিল করেন।
অপারেশন ব্রাস ট্যাকস এবং পারমাণবিক প্রতিরোধ
১৯৮৭ সালে, ভারত ‘অপারেশন ব্রাস ট্যাকস’ নামে একটি বিশাল সামরিক মহড়া শুরু করে, যেখানে ৮ লাখের বেশি সৈন্য পাকিস্তানের সীমান্তে জড়ো হয়। ইসলামাবাদ এটিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে দেখে। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে দুই দেশ একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল।
১৯৯৮ সালে ভারত আরও পাঁচটি পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। ভারত থেকে ইসরায়েলের বিমান হামলার গুজবের মধ্যে পাকিস্তানও নিজস্ব পরীক্ষার মাধ্যমে একটি বিশ্বাসযোগ্য পারমাণবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে।
বিতর্ক ও ফলাফল
পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা কিছু নিষেধাজ্ঞা ও বিতর্ক নিয়ে আসে। ২০০০-এর দশকের শুরুতে ড. এ কিউ খানকে ইরান, উত্তর কোরিয়া এবং লিবিয়ার কাছে পারমাণবিক গোপনীয়তা বিক্রির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোশাররফ তাকে গৃহবন্দী করেন এবং তাকে জাতীয় টেলিভিশনে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু ২০০৭ সালে মোশাররফ ক্ষমতাচ্যুত হলে ড. খানের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ বাতিল করা হয়।
এই পারমাণবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধ প্রতিরোধে সহায়তা করেছে বলে মনে করা হয়। কারণ পাকিস্তান এখন আর কোনো চাপ বা জবরদস্তির শিকার হয় না। তাদের কাছে চূড়ান্ত শক্তি থাকায়, তারা যেকোনো হামলার যোগ্য জবাব দিতে পারে। ভারত এখন আর পাকিস্তানকে লেবাননের মতো দুর্বল প্রতিবেশি মনে করে না।