হিউমান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন - ভারতীয় নাগরিক হয়েও মুসলিমদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে - দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ
নোটিশ:
শিরোনামঃ
চবি ও বাকৃবিতে সন্ত্রাসী হামলায় প্রতিবাদে ইবি ছাত্রদলের বিক্ষোভ  ডাকসু নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের বৈঠক, গুজবের জবাব মিলল আলোচনায় অন্যরকম পাঠশালার প্রাক্তন গণিত শিক্ষক আশিকুজ্জামান রাসেল এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রফেসর চ্যাটজিপিটি পরামর্শে বিরল রোগে আক্রান্ত মার্কিন নাগরিক, সতর্ক করল মেডিকেল জার্নাল আফগানিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহত বেড়ে ৮০০, আহত আড়াই হাজারের বেশি ইন্দোনেশিয়ায় শিক্ষার্থী ও নাগরিক সংগঠনের বিক্ষোভ স্থগিত, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার জাককানইবি কেসস্প্রিন্ট ২০২৫ এর গ্র্যান্ড ফিনালে:বিজয়ী দল ‘ব্যাকসিট ড্রাইভার্স’ আমরণ অনশনের মুখে নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বাংলায় কথা বলার অপরাধে কলকাতায় এক হিন্দু যুবককে তিরস্কার

হিউমান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন – ভারতীয় নাগরিক হয়েও মুসলিমদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০২৫
  • ৭২ বার দেখা হয়েছে

২০২৫ সালের মে মাস থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে শয়ে শয়ে বাংলাভাষী মুসলমান নারী, পুরুষ ও শিশুদের কোনো প্রক্রিয়া না মেনে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউমান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানিয়েছে, যাদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাদের অনেকে ভারতীয় নাগরিক এবং তারা ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর বাসিন্দা। আবার, এদের অনেকেই কাগজপত্রসহ প্রমাণ পেশ করেও নাগরিকত্ব স্বীকার করাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সীমান্তে পুশব্যাকের সময় গায়ে লাঠি বর্ষণ, গুলি চালানো, হাত বেঁধে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বিবরণ উঠে এসেছে সংস্থাটির গবেষণায়।

২০২৫ সালের ৭ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) জানিয়েছে, অন্তত ১,৫০০ মুসলমান—তাদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাও রয়েছে—ভারত থেকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই সংখ্যা আরও বাড়ছে। কিন্তু ভারত সরকার এই বিষয়ে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করেনি।

হিউমান রাইটস ওয়াচ জানায়, আসাম, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওড়িশা ও রাজস্থানের বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে এই অভিযান চলছে। এসব রাজ্যে মূলত দরিদ্র মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের টার্গেট করে আটক করে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের নামে মুসলিমদের হেনস্থা, মিথ্যা তথ্য দিয়ে নাগরিকত্ব অস্বীকার, মোবাইল ফোন ও কাগজপত্র কেড়ে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। আটক ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে।

আসামের সাবেক স্কুলশিক্ষক খায়েরুল ইসলাম জানান, তাকে ১৪ জনের সঙ্গে ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফ জোর করে বাংলাদেশে পাঠায়। তার হাত বেঁধে, মুখ চেপে ধরে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে গুলি ছুড়ে ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। তিনি নিজেই বলেন, “আমি বাধা দিলে বিএসএফ অফিসার আমাকে মারধর করে এবং চারবার গুলি ছোড়ে।” দুই সপ্তাহ পর তিনি কোনোভাবে ফিরে আসতে সক্ষম হন। অথচ তার নাগরিকত্বের মামলা এখনো ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।

এমন অনেক ঘটনার বর্ণনা উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। কারো মায়ের বয়স ৬৭, চোখে ভালো দেখে না, হেঁটে চলাফেরা করতে পারে না—তবুও তাকে মধ্যরাতে সীমান্তে নিয়ে পুশব্যাক করা হয়েছে। কেউ আবার তিন দিন হেঁটে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন। আবার কেউ কেউ রাতভর জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে, অবশেষে নদী পার হয়ে ফিরে এসেছেন ভারতের দিকে।

বিশেষ করে ২০১৯ সালে আসামে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) চালুর সময় প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাদ পড়েছিল। এদের অনেকেই মুসলমান, এবং যাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল, তারা পরে “বিদেশি” হিসেবে ঘোষণা পায়। তখন থেকেই নাগরিকত্ব যাচাইয়ের নামে নিরীহ মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে আসে। অনেকেই একাধিকবার ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করেছেন, কিন্তু আবারও নতুনভাবে “বিদেশি” ঘোষণা করা হচ্ছে একতরফা সিদ্ধান্তে।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা গত মে মাসে স্বীকার করেন যে, তারা ৩৩০ জন “অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে” বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে এনআরসি-র বাইরে এমন সবাইকে বিচার ছাড়াই সরাসরি ফেরত পাঠানো হবে। অথচ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, যাদের পুশব্যাক করা হয়েছে, তাদের অনেকে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন বা উচ্চ আদালতে মামলার নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু আদালতের আদেশ উপেক্ষা করেই তাদের সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রিপোর্ট অনুযায়ী, মুম্বাই থেকে কয়েকজন পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম শ্রমিককে ধরে নিয়ে গিয়ে বিএসএফ এর বিমানযোগে ত্রিপুরা রাজ্যে পাঠিয়ে সীমান্ত পার করানো হয়। এক মজুর জানান, “পুলিশ আমার ফোন কেড়ে নেয়, পরিচয়পত্র ছিঁড়ে ফেলে। আমরা বলছিলাম আমরা ভারতীয়, কিন্তু কেউ শুনছিল না। বেশি কথা বললে মারত। আমাকে লাঠি দিয়ে পেটানো হয় এবং বলা হয় আমি যেন বলি আমি বাংলাদেশি।”

রিপোর্টে উঠে আসে গুজরাটের ঘটনা, যেখানে আহমেদাবাদের চাঁদোলা লেকের পাশে “বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী” অভিযোগে প্রায় ১০,০০০ বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে যে নির্দেশ দিয়েছিল—যাতে উচ্ছেদের আগে নোটিশ ও আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের কথা বলা হয়েছিল—তা পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এমনকি ধৃতদের শহরের রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে।

এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরও। তারা বলেছে, “জাতীয় নিরাপত্তা বা বিদেশি নাগরিকত্বের অজুহাত দেখিয়ে কোনো সম্প্রদায়কে আইনবহির্ভূতভাবে উচ্ছেদ করা মানবাধিকার লঙ্ঘন।”

 বাংলাদেশিদের আটক রাখার জন্য গোয়ালপাড়া জেলায় গড়া হয়েছে ভারতের বৃহত্তম ডিটেনশন সেন্টার

বাংলাদেশিদের আটক রাখার জন্য গোয়ালপাড়া জেলায় গড়া হয়েছে ভারতের বৃহত্তম ডিটেনশন সেন্টার

রিপোর্টে উঠে আসে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়েও ভয়ংকর বিবরণ। দিল্লি ও আসামের ডিটেনশন সেন্টার থেকে একশ’র মতো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং অন্তত ৪০ জনকে সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, হাতে লাইফ জ্যাকেট দিয়ে। জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুস একে “মানবিক শালীনতার অবমাননা” এবং “ননরিফাউলমেন্ট”-এর লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছেন। এটি সেই আন্তর্জাতিক নীতি, যেখানে কাউকে এমন কোনো জায়গায় ফেরত পাঠানো যায় না যেখানে তার জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করিয়ে দিয়েছে, ভারত আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার চুক্তি ও জাতিগত বৈষম্য বিলোপের চুক্তির সদস্য এবং তারা বাধ্য—নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা, মানবিক আচরণ বজায় রাখা এবং জাতি, ভাষা, ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে বঞ্চিত না করার ব্যাপারে। কিন্তু বাস্তবে ভারত সরকার নিজেদের দায় এড়াতে জাতীয় নিরাপত্তা ও অবৈধ অনুপ্রবেশের অজুহাতে হাজার হাজার মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকার একাধিকবার আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে—তারা শুধু তাদের নাগরিকদেরই নেবে, যারা প্রমাণসহ সঠিক চ্যানেলের মাধ্যমে ফেরত পাঠানো হবে। কিন্তু ভারত সেই প্রতিষ্ঠিত প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে না।

সবশেষে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলেন, “ভারত সরকার মূলত মুসলমানদের টার্গেট করে যেভাবে বিতাড়নের অভিযান চালাচ্ছে, তা ভারতের ঐতিহ্য, আইনি কাঠামো এবং মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে।”

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT