
অবশেষে বার্সেলোনার সেই স্বপ্নের ১০ নম্বর জার্সির নতুন অধিকারী হলেন ‘বিস্ময় বালক’ লামিনে ইয়ামাল। এটি শুধুই একটি জার্সি বদলের গল্প নয়, বরং একটি আত্মিক যাত্রার শুরু, ভালোবাসা, ইতিহাস এবং বিশ্বাসের এক দুর্লভ সংমিশ্রণ। কিংবদন্তি লিওনেল মেসির রেখে যাওয়া ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এবার নিজের গল্প শুরু করতে চলেছেন মাত্র ১৭ বছর বয়সী এই তরুণ।
সাম্প্রতিক এক আয়োজনে ক্যাম্প ন্যু স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ নম্বর জার্সি তুলে দেওয়া হয় ইয়ামালের হাতে। সেই মুহূর্তে তার পাশে ছিলেন পরিবারের প্রিয়জনরা—বাবা, ছোট ভাই, বন্ধু এবং সবচেয়ে বড় প্রেরণা, তার প্রিয় দাদী ফাতিমা। ঠিক এই দাদীর অনুপস্থিতিতেই গত মে মাসে বার্সার সঙ্গে ২০৩১ সাল পর্যন্ত চুক্তি নবায়নের পরেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেননি ইয়ামাল। কারণ তিনি চেয়েছিলেন, এমন ঐতিহাসিক মুহূর্তে তার দাদী যেন পাশে থাকেন। আর এবার সেই আবেগঘন ছবিই ধরা পড়লো তার ইনস্টাগ্রামে প্রকাশিত এক ভিডিওতে—যেখানে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বসে বার্সার ১০ নম্বর জার্সির একটি আঁকা ছবি নিয়ে আলাপ করছেন ইয়ামাল।
এই তরুণ স্প্যানিশ তারকা বলেন, “এই জার্সি পরে শুধু ভালো খেললেই চলবে না। অনেকে এই জার্সি গায়ে দিয়ে ইতিহাস গড়েছেন, আনন্দ পেয়েছেন। আর একজন তো—আমার দেখা সর্বকালের সেরা।” তার এই কথাতেই ফুটে উঠেছিল কিংবদন্তি লিওনেল মেসির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। কারণ এই ১০ নম্বর জার্সিটিই এক সময় মেসিকে ঘিরে তৈরি করেছিল অসংখ্য ইতিহাস।
যখন তার ছোট ভাই তাকে একটি হাতে আঁকা ১০ নম্বর জার্সির ছবি উপহার দেয়, তখন ইয়ামাল আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, “আমি আমার সর্বস্ব নিংড়ে দেব। আমি নিজেই আমার ইতিহাস গড়ব।”
এটা নিছক কথার কথা নয়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই বার্সার হয়ে খেলেছেন ১০৬টি ম্যাচ, করেছেন ২৫টি গোল, জিতেছেন লা লিগা শিরোপা, আর স্পেনের জাতীয় দলের হয়ে জয় করেছেন ইউরো কাপ। তার ফুটবল যাত্রার শুরুটাও হয়েছিল কিংবদন্তি মেসির মতো ১৯ নম্বর জার্সি দিয়ে। আর এবার তার গায়ে উঠেছে সেই ১০ নম্বর, যেটি পরে মেসি সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাসের পর ইতিহাস।
ইয়ামাল বলেন, “ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল বার্সার হয়ে অভিষিক্ত হব এবং ১০ নম্বর জার্সিটা পরে খেলব। মেসি তার মতো করে এটা গড়েছেন, আমি আমার মতো করে গড়ব।”
তবে এই মাহেন্দ্রক্ষণকে ঘিরে বিতর্কও তাকে ছাড়েনি। নিজের ১৮তম জন্মদিন উদ্যাপনের সময় ‘বামন’ ভাড়া করে পার্টি দেওয়ায় স্পেনের সামাজিক অধিকারবিষয়ক মন্ত্রণালয় তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। তবে এসব বিষয়ে তিনি মুখ খুলতে নারাজ। বলেন, “আমি জীবনের আনন্দ নিই নিজের মতো করে, অন্য কারও সমালোচনায় আমার আগ্রহ নেই।”
এই তরুণের জীবনের বড় অংশজুড়ে রয়েছে তার ধর্মীয় ও পারিবারিক পরিচয়। ২০০৭ সালের ১৩ জুলাই স্পেনের এসপ্লুগুয়েস দে লোব্রেগাট এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন লামিনে ইয়ামাল। তার বাবা মুনির নাসরাউই মরক্কোর নাগরিক এবং মুসলিম। মা শীলা এবানা বিষুবীয় গিনিয়ান, তিনি খ্রিস্টান হলেও ইয়ামাল বেড়ে উঠেছেন ইসলামী আদর্শে। ছোট থেকেই তার বিশ্বাস গড়ে উঠেছে দাদি ফাতিমার হাতে। ‘মাদরি’ নামেই তিনি তাকে ডাকেন। মাঠে নামার আগে নিয়ম করে দাদি শেখানো দোয়া পড়েন ইয়ামাল। দাদীর কাছ থেকেই তার আত্মিক চরিত্র গঠনের ভিত্তি। ম্যাচে মাঠে নামার আগেও ইয়ামাল বিশেষ দোয়া পড়ে থাকেন, যা তার দাদী শিখিয়ে দিয়েছেন। স্প্যানিশ মুসলিম সমাজে তাকে এখন নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণার প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
২০২৫ সালে রমজানে তিনি রোজা পালন করেন এবং মুসলিম হিসেবে নিজের ধর্মীয় চর্চা নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। তার নিজের কথায়, “I fast during Ramadan… It is about your faith and your religion.”
রমজান মাসে রোজা রাখা ও ধর্মীয় অনুশাসন মানা নিয়েও ইয়ামালের অবস্থান স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি রোজা রাখি, এটা আমার বিশ্বাস এবং ধর্মীয় দায়িত্ব। এটাই আমার পরিচয়ের বড় অংশ।” খেলাধুলার পাশাপাশি তার ধর্মীয় চর্চা এবং বিশ্বাস তাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে বলে জানিয়েছেন অনেকে।
এখন বার্সার ১০ নম্বর জার্সি গায়ে, প্রিয় দাদি ফাতিমাকে পাশে রেখে ইয়ামালের যাত্রা শুরু হয়েছে এক নতুন অধ্যায়ে। ফুটবল ইতিহাসের পাতা উল্টে এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা—এই তরুণ কীভাবে নিজেকে স্থায়ী করে তোলেন কিংবদন্তিদের কাতারে।