চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও ৩১ মে ঢাকা সফরে আসছেন। তিনদিনব্যাপী এই সফরে তিনি প্রায় ৩০০ সদস্যের একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন—এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বিদেশি বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদল বলে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।এই বিশাল প্রতিনিধিদলে চীনের টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস, ইলেকট্রনিক্স ও কৃষি খাতের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। শিল্প সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এই সফরের মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে যৌথ বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
সফরের প্রস্তুতি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, বিডা, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো সমন্বিত প্রস্তুতি শুরু করেছে। ৩১ মে দুপুরে ঢাকায় অবতরণ করার পর সেদিন বিকেলেই ওয়াং ওয়েনতাও বাণিজ্য উপদেষ্টা এস কে বশির উদ্দিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হবেন।
১ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস প্রধান অতিথি হিসেবে চীনা প্রতিনিধিদলকে নিয়ে একটি ব্যবসায়িক সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। এরপর দিনব্যাপী পাঁচটি ‘ম্যাচ-মেকিং’ সেশনের মাধ্যমে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা পরস্পরের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করবেন।
বিডা সূত্র জানায়, আলোচ্য খাতগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি), ইলেকট্রনিক্সসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাত অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
চীনা প্রতিনিধিদলে দেশটির প্রধান খাতভিত্তিক ব্যবসায়িক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। এদের অনেকেই এর আগে চীনে প্রধান উপদেষ্টার সফরের সময় আয়োজিত বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, “বেজা ও বিডা চীনা বিনিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ী যেকোনো অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি বরাদ্দ দেওয়ার চেষ্টা করবে, এমনকি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে গঠিত অঞ্চলেও সুযোগ দেওয়া হবে। ম্যাচ-মেকিং সেশনগুলোর মাধ্যমে যৌথ বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা যাবে।”
১ জুন সন্ধ্যায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ চীনা প্রতিনিধিদলের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করবেন।
২ জুন বাংলাদেশ–চীন যৌথ অর্থনীতি ও বাণিজ্য কমিশনের বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন ওয়াং ওয়েনতাও। এই বৈঠকে বাংলাদেশ পক্ষের নেতৃত্ব দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ইতিমধ্যেই ওয়াং আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি পাঠিয়েছেন বৈঠকের বিষয়ে।
পরবর্তীতে, ২ জুন ১৪টি চীনা কোম্পানির ৩০ জন প্রতিনিধি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে একটি বিশেষ ‘ম্যাচ-মেকিং’ সেশনে অংশ নেবেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, চীনা কোম্পানিগুলো কৃত্রিম ফাইবার, সবুজ টেক্সটাইল প্রযুক্তি ও হোম টেক্সটাইল খাতে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বের সুযোগ খুঁজছে।
বিজিএমইএর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল নির্মাতাদের সঙ্গে কৃত্রিম ফাইবার, টেক্সটাইল ইনোভেশন ও হোম টেক্সটাইল খাতে ব্যবসায়িক সহযোগিতা গড়ে তুলতে চায়, যা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং জ্ঞান ও দক্ষতার স্থানান্তর ঘটাবে।”
উল্লেখযোগ্য যে, কৃত্রিম ফাইবার বর্তমানে বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় না, যদিও বৈশ্বিক চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
একই দিনে প্রতিনিধি দলের একটি অংশ গাজীপুরের লিজ ফ্যাশন গার্মেন্টস পরিদর্শনে যাবে। ওয়াং ওয়েনতাও সেদিন রাতেই ঢাকা ত্যাগ করবেন।
এই সফরে আনুষ্ঠানিক কোনো বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা না থাকলেও, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সুসংহত করার লক্ষ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হতে পারে। মার্চ মাসে চীন এ সংক্রান্ত একটি খসড়া প্রস্তাব বাংলাদেশকে দিয়েছে।
যদিও চীনের বিনিয়োগ আগ্রহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, তবুও বাংলাদেশের চীনে রপ্তানি এখনও সীমিত।
২০২২–২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে পণ্য রপ্তানি করেছে মাত্র ৭১৫ মিলিয়ন ডলারের, যা মোট রপ্তানির মাত্র ১.৬১%।
অন্যদিকে, চীন থেকে আমদানি ছিল প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের মোট আমদানির এক-তৃতীয়াংশের মতো। এ আমদানির বড় অংশই শিল্প কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি।
চীনা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বেজা আনোয়ারা, চট্টগ্রামে একটি বিশেষ চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। এছাড়া চাঁদপুর ও ভোলায় আরও দুটি অঞ্চল অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ সম্প্রতি আরও জোরদার হয়েছে, বিশেষ করে ইউনান প্রদেশের গভর্নর ওয়াং ইউবো-র বাংলাদেশ সফর এবং বিভিন্ন বিনিয়োগ সম্মেলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের পর।
সূত্র: দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড