১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এই অভ্যুত্থান নিয়ে প্রচলিত বিভিন্ন মত এবং বিতর্ক রয়েছে। সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের সাথে ইউটিউবে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে ১৫ই আগস্টের অন্যতম পরিকল্পনাকারী এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ চৌধুরী (বীর প্রতীক) সেই রাতের ঘটনা এবং এর পেছনের কারণগুলো নিয়ে তার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন।
সাক্ষাৎকারে রাশেদ চৌধুরী ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থান একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, বরং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ফলস্বরূপ এটি ঘটেছিল। তার কথায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, দেশের ভেতরে একটি অসন্তোষ দানা বাঁধছিল। তার মতে, স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা, যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, তারা ডিমরালাইজড বা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। যে স্পিরিট নিয়ে তারা যুদ্ধ করেছিলেন, সেই স্পিরিট তাদের মধ্যে আর ছিল না।
রাশেদ চৌধুরীর বক্তব্যে সেই সময়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটি চিত্র উঠে আসে। তিনি উল্লেখ করেন যে, ১৯৭২ সালের পর থেকে দেশের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে, সেনাবাহিনী একটি পরিবর্তন আনার জন্য উদ্যোগী হতে বাধ্য হয়। তারা অনুভব করে যে, দেশের ভবিষ্যৎ এবং স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের মতে, তৎকালীন সরকার দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হচ্ছিল, যার কারণে সেনাবাহিনী এই পদক্ষেপ নেয়। তিনি আরও বলেন, এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তারা দেশকে ভালোবাসেন বলেই এই কাজটি করেছেন। তিনি নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেন, তিনি পাকিস্তান থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। কাজেই, তার মতো দেশপ্রেমিকরা দেশের খারাপ পরিস্থিতি দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারেন না।
রাশেদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকারে তৎকালীন রক্ষীবাহিনীকে নিয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়। তার বর্ণনা অনুযায়ী, রক্ষীবাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত অনুগত ছিল। ১৫ই আগস্টের রাতে অভ্যুত্থানকারীরা যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে অগ্রসর হন, তখন পথে রক্ষীবাহিনীর একটি টহল দলের সাথে তাদের মুখোমুখি হয়। আরেকটি দল রেডিও স্টেশন অভিমুখে রওনা দেয়, দলটিতে রাশেদ চৌধুরী ছিলেন।
রাশেদ চৌধুরী তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, রেডিও স্টেশন দখল নেবার পর রক্ষীবাহিনীর একটি দল ট্রাক সহকারে সেখানে আসছিলো। রক্ষীবাহিনীর সুবেদারকে গাড়ি থেকে তিনি নামতে বলেন। তিনি সুবেদারকে জানান যে, সেনাবাহিনী সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে এবং এখন সব সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি তাদের তার সাথে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। সুবেদার প্রথমে ভয়ে তাদের সাথে থাকার কথা জানালেও, রাশেদ চৌধুরী লক্ষ করেন যে, রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা চতুর্দিক থেকে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেখে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলার সাহস পায়নি। বরং তারা শান্তভাবে নিজেদের অস্ত্র গাড়িতে রেখে নিচে নেমে আসে এবং তাদের কথা মেনে নেয়, সুবেদার মুজিবের মৃত্যুতে স্বস্তি প্রকাশ করে তাকে বলেন আপনারা আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন নয়ত জনসাধারণের হাতে বেঘরে প্রাণ হারাতে হতো। এই ঘটনা থেকে রাশেদ চৌধুরী বোঝাতে চেয়েছেন যে, রক্ষীবাহিনী প্রকৃতপক্ষে জনগণের সমর্থনপুষ্ট কোনো বাহিনী ছিল না, বরং সামরিক শক্তির সামনে তারা সহজেই আত্মসমর্পণ করে। এটি তাদের দুর্বলতা এবং জনগণের প্রতি তাদের বিচ্ছিন্নতার প্রমাণ দেয় বলে তার বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়।
১৫ই আগস্টের রাতের ঘটনা প্রসঙ্গে রাশেদ চৌধুরী তার সহযোদ্ধা বজলুল হুদার জবানিতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেন। তার মতে, এই অভ্যুত্থান আকস্মিকভাবে শুরু হয় শেখ কামালের দিক থেকে ছোড়া গুলির মাধ্যমে। হুদা তাকে জানিয়েছিলেন যে, ১৫ই আগস্টের সকালে যখন তারা ৩২ নম্বরের বাড়িতে পৌঁছান, তখন পরিস্থিতি শান্ত ছিল। বজলুল হুদা বাড়ির ভেতরে প্রবেশের পর শেখ কামাল এবং তার স্ত্রী সুলতানা তাদের দিকে গুলি ছোড়েন। এই গোলাগুলির প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সশস্ত্র অভ্যুত্থানকারীরা পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হন। বজলুল হুদার ভাষ্য অনুযায়ী, কামাল প্রথমে গুলি ছোড়েন এবং তার সাথে তার স্ত্রীও গুলি ছোড়েন। এই ঘটনা থেকেই পুরো সশস্ত্র সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় এবং এর ফলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রাশেদ চৌধুরীর মতে, এই ঘটনাটি যদি না ঘটত, তবে হয়তো পুরো পরিস্থিতির গতিপথ ভিন্ন হতে পারত।
সাক্ষাৎকারে রাশেদ চৌধুরী জোর দিয়ে বলেছেন যে, ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনায় শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি বলেন, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কেবল শেখ মুজিবকে ক্ষমতা থেকে সরানো। তিনি বজলুল হুদার বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন যে, তারা যখন ৩২ নম্বরের বাড়িতে প্রবেশ করেন, তখন তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল শেখ মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করা। শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের ওপর যে নির্মমতা দেখানো হয়েছে, বিশেষ করে শিশু শেখ রাসেলকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়, সেই ন্যারেটিভকে তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যাচার বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, এই ধরনের ঘটনা একেবারেই উদ্দেশ্যমূলক ছিল না।
সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়, কেন শিশু শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হলো, যার উত্তরে রাশেদ চৌধুরী বলেন, তাদের পরিকল্পনায় রাসেলকে হত্যার কোনো স্থান ছিল না। তার বক্তব্য অনুযায়ী, পুরো ঘটনাটি অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটেছিল এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। রাশেদ চৌধুরী বলেন, যারা এই অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন, তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তারা কখনই এমন নৃশংসতা পরিকল্পনা করেননি। তিনি অভিযোগ করেন যে, ১৫ই আগস্টের ঘটনার পর একটি মিথ্যা প্রচার চালানো হয়েছে, বিশেষ করে শেখ হাসিনা যেভাবে তার পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভিত্তিহীন। রাশেদ চৌধুরী সাক্ষাৎকারে জানান, শিশু শেখ রাসেলকে হত্যার কথা একটি বানানো গল্প, যা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ব্যবহার করা হয়। মুজিবের পরিবার বাড়ির দোতলার একটি কক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো। সেখানে শেখ কামালের গোলাগুলির পর এক সৈনিক প্রাণ হারানোয় উত্তেজিত সৈনিকেরা সেই কক্ষে জানালায় ২/৩টি গ্রেনেড ছুঁড়ে দেয়। এরপরের পরিণতি সকলেরই জানা আছে।
রাশেদ চৌধুরীর মতে, শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে কোনো শোক বা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের পর যখন খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয় এবং রেডিওতে ঘোষণা আসে, তখন দেশের মানুষ অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। তিনি ইঙ্গিত দেন যে, তৎকালীন সরকারের প্রতি জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ছিল এবং তাই পরিবর্তনের খবর শুনে তারা খুশি হয়েছিল। রাশেদ চৌধুরী বলেন, তিনি এবং তার সহকর্মীরা ভেবেছিলেন যে, অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর হয়তো সারাদেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, কিন্তু বাস্তবে এমন কিছু ঘটেনি। তার মতে, জনগণের এই ধরনের নীরবতা এবং স্বাভাবিক আচরণ প্রমাণ করে যে, তৎকালীন সরকার তাদের কাছ থেকে সমর্থন হারিয়েছিল। এই ঘটনাটি তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, শেখ মুজিব ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার এবং জনগণের দুর্ভোগ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, মানুষ এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছিল। ঢাকার রাস্তায় আনন্দ মিছিলে নেমে পড়ে আপামর জনতা। শেষ হয় মুজিব নামক এক মুক্তির নায়ক থেকে বনে যাওয়া এক স্বৈরাচারের শাসন।