ইতিহাসের পাতায় কিছু ঘটনা এমনভাবে খোদাই হয়ে যায় যা মানুষের হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমের পতন এমনই এক ঘটনা। প্রথম ক্রুসেড, যা খ্রিস্টানদের পবিত্র যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত, ইউরোপ থেকে আসা ক্রুসেডারদের দ্বারা পবিত্র ভূমি দখলের এক নির্মম অভিযান।
প্রথম ক্রুসেডের শুরু হয় ১০৯৫ সালে, যখন পোপ আরবান দ্বিতীয় ক্লারমন্ট কাউন্সিলে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের পবিত্র যুদ্ধের আহ্বান জানান। তাঁর লক্ষ্য ছিল মুসলিমদের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধার করা, যা খ্রিস্টানদের কাছে পবিত্র ভূমি। এই অভিযানের আগে একটি আন-অফিসিয়াল ক্রুসেড হয়, যা “পিপলস ক্রুসেড” নামে পরিচিত। পিটার দ্য হার্মিটের নেতৃত্বে ৮৮০,০০০ সাধারণ মানুষ, যাদের অধিকাংশই ছিল দরিদ্র এবং অপ্রশিক্ষিত, কনস্টানটিনোপল হয়ে অ্যানাটোলিয়ায় প্রবেশ করে। কিন্তু সেলজুক তুর্কিদের কাছে তারা পরাজিত হয়, কারণ তারা সত্যিকারের সেনাবাহিনী ছিল না।
এরপর আসল অভিযান, “প্রিন্সেস ক্রুসেড”, যা ১০৯৬ সালের শেষভাগে শুরু হয়। এতে ফ্রান্স, ইতালি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ থেকে আসা ১৫০,০০০ প্রশিক্ষিত সেনা অংশ নেয়। তারা কনস্টানটিনোপলে পৌঁছে বাইজানটাইন সম্রাটের সাহায্যে বসফরাস পার হয় এবং সেলজুকদের মুখোমুখি হয়। সেলজুক রাজধানী নাইসিয়া দখল করে তারা সেলজুক সাম্রাজ্যকে পাঁচটি ছোট রাজ্যে বিভক্ত করে। এরপর তারা দক্ষিণে অ্যান্টিওক (আনতাকিয়া) অভিমুখে যায়। অ্যান্টিওকের অবরোধ ১০৯৭-৯৮ সালে চলে, যা দীর্ঘকালীন ছিল। ক্রুসেডাররা ইউরোপ থেকে অতিরিক্ত সাহায্য পায় এবং একজন অভ্যন্তরীণ খ্রিস্টানের সাহায্যে শহরের গেট খুলে দখল করে।
অ্যান্টিওক দখলের পর, ক্রুসেডার নেতা গডফ্রে ডি বুইয়ন উত্তর ইরাকে এডেসা (রুহা) দখল করে একটি খ্রিস্টান রাজ্য স্থাপন করে, যা ক্রুসেডারদের প্রথম রাজ্য। ক্রুসেডাররা লেবাননের বৈরুতসহ অন্যান্য শহর দখল করে।
অবশেষে, ১০৯৯ সালের জুন মাসে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম পৌঁছে। তখন জেরুজালেম ফাতিমিদ শিয়াদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যারা সেলজুকদের সাথে যুদ্ধের সুযোগে এটি দখল করেছিল। ক্রুসেডাররা শহর অবরোধ করে, ক্যাটাপুল্ট, মোবাইল টাওয়ার এবং অন্যান্য উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করে। অবরোধ ৪২ দিন চলে, এবং ১৫ জুলাই, ১০৯৯-এ তারা শহরের দেওয়াল ভেঙে প্রবেশ করে। ফাতিমিদ গভর্নর ইফতিকার আদ-দাউলা আত্মসমর্পণ করে, কিন্তু ক্রুসেডাররা সকলকে হত্যা করে শহর দখল করে। উইকিপিডিয়ার “সিজ অফ জেরুজালেম (১০৯৯)” অনুসারে, এটি প্রথম ক্রুসেডের সফল সমাপ্তি ছিল, যা খ্রিস্টানদের জন্য একটি “অলৌকিক” বিজয়।
এই দখলের পিছনে ছিল ধর্মীয় উন্মাদনা এবং রাজনৈতিক লোভ। ক্রুসেডাররা জেরুজালেমকে “খ্রিস্টের ভূমি” মনে করে এগিয়ে যায়, এবং গডফ্রে ডি বুইয়ন প্রথম রাজা হয়ে ওঠেন “কিংডম অফ জেরুজালেম”-এর। এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতি পরিবর্তন করে দেয়, যা দুই শতাব্দীর ক্রুসেড যুদ্ধের সূচনা করে।
মুসলিমদের পরাজয়ের কারণ ছিল অভ্যন্তরীণ বিভেদ এবং ঐক্যের অভাব। সাবটাইটেলে বর্ণিত হিসেবে, সেলজুক সাম্রাজ্য ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, ১০৭৭ সালে দুটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে। ক্রুসেডারদের নাইসিয়া দখলের পর এটি পাঁচটি রাজ্যে বিভক্ত হয়, যা তাদের শক্তি হ্রাস করে। ফাতিমিদ শিয়ারা, যারা মিশরভিত্তিক, সেলজুক সুন্নিদের সাথে শত্রুতা পোষণ করতো। তারা ক্রুসেডারদের সাথে চুক্তি করার চেষ্টা করে, উত্তর সিরিয়া তাদের দিয়ে দক্ষিণ সিরিয়া নিজেরা রাখার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু জেরুজালেম নিয়ে মতভেদ হয়। ফাতিমিদরা ক্রুসেডারদের নাইসিয়া বিজয়ে অভিনন্দন পাঠায় এবং উপহার দেয়, যা বিশ্বাসঘাতকতার চরম উদাহরণ।
আব্বাসীয় খিলাফতও দুর্বল ছিল। অ্যান্টিওকের অবরোধে আব্বাসীয় সেনা দেরিতে পৌঁছে, এবং অভ্যন্তরীণ বিবাদের কারণে পরাজিত হয়। ক্রুসেডাররা একটি “পবিত্র কুঠার” আবিষ্কারের নাটক করে মোরাল বাড়ায়, যখন মুসলিমরা অভ্যন্তরীণ ঝগড়ায় ব্যস্ত। ত্রিপোলির অবরোধে মুসলিমরা সাহায্য চায় আব্বাসীয়, ফাতিমিদ এবং অন্যান্যদের কাছে, কিন্তু কোনো সাহায্য আসে না। ফাতিমিদরা খ্রিস্টানদের সাথে হাত মিলিয়ে মিশরের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলো।
ঐতিহাসিকভাবে, লুমেন লার্নিং-এর “দ্য ফার্স্ট ক্রুসেড” অনুসারে, মুসলিমদের পরাজয়ের কারণ ছিল রাজনৈতিক বিভাজন এবং সেলজুক-ফাতিমিদ শত্রুতা, যা ক্রুসেডারদের সুযোগ দেয়। কেমব্রিজ ওয়ার্ল্ড হিস্টরি অফ জেনোসাইডে বলা হয়, মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ না হওয়ায় ক্রুসেডাররা সহজেই অগ্রসর হয়। এছাড়া, ক্রুসেডারদের উন্নত অস্ত্র এবং ইউরোপীয় সাহায্য মুসলিমদের দুর্বলতাকে আরও প্রকট করে। এই পরাজয় মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি শিক্ষা: বিভেদ ঐক্যের শত্রু।
জেরুজালেম দখলের পর ক্রুসেডাররা একটি নির্মম গণহত্যা চালায়, যা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলোর একটি। তারা পুরুষ, নারী, শিশু সকলকে হত্যা করে। ফাতিমিদ গভর্নর একটি দুর্গে লুকিয়ে পড়ে, যখন লোকেরা আল-আকসা মসজিদে আশ্রয় নেয়। প্রায় ১০০,০০০ লোক মসজিদ এবং আশেপাশে ছিল, কিন্তু ক্রুসেডার কমান্ডারের নির্দেশে সকলকে হত্যা করা হয়। রক্ত নদী হয়ে যায়, যা হাঁটুর উচ্চতায় পৌঁছে, এবং দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেসে বেড়ায়।
ক্রুসেডাররা আল-আকসাকে ভাগ করে: এক অংশ চার্চ, এক অংশ সৈনিকদের থাকার জায়গা, এক অংশ স্টোরেজ এবং ভূগর্ভস্থ অংশ ঘোড়ার আস্তাবল। এটি ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থানের প্রতি চরম অসম্মান। বিপরীতে, যখন সালাহউদ্দিন আয়্যুবী জেরুজালেম উদ্ধার করেন, তিনি খ্রিস্টানদের সুরক্ষা দেন। কিন্তু ক্রুসেডাররা ধর্মীয় উন্মাদনায় এই নৃশংসতা চালায়।
ঐতিহাসিক সোর্সে, আই উইটনেস টু হিস্টরিতে বলা হয়, ক্রুসেডাররা ধর্মীয় উপাসনালয়ে লুকানো লোকদের হত্যা করে বা জীবিত রেখে তাদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করে। হিস্টরি স্কিলসে উল্লেখ, সিনাগগে আশ্রয় নেওয়া লোকদের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। এটি ইহুদি এবং মুসলিমদের গণহত্যা ছিল, যা ধর্মীয় সহিংসতার এক চরম উদাহরণ। এই গণহত্যা ক্রুসেডারদের “পবিত্রতা” এবং মুসলিমদের কষ্টের মধ্যে একটি করুণ বৈপরীত্য সৃষ্টি করে, যা আজও হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়।
প্রথম ক্রুসেডের জেরুজালেম পতন মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি ট্র্যাজেডি, কিন্তু এটি ঐক্যের গুরুত্ব শেখায়। পরবর্তীতে সালাহউদ্দিন জেরুজালেম উদ্ধার করেন, যা আশার আলো। টেলর অ্যান্ড ফ্রান্সিসের গবেষণায় বলা হয়, এই গণহত্যা ধর্মীয় সহিংসতার একটি অসাধারণ উদাহরণ। আজকের বিশ্বে এই ঘটনা আমাদের সহনশীলতা এবং ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দেয়।