বাংলাদেশের খুচরা বাজারে দীর্ঘদিন ধরে সুপার স্টোর এবং ঐতিহ্যবাহী মুদি দোকানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থা বিরাজ করছিল। সুপার স্টোরগুলোতে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) প্রযোজ্য থাকায় মুদি দোকানগুলোর তুলনায় তাদের পণ্যের দাম কিছুটা বেশি ছিল। এটি তাদের ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতাকে প্রভাবিত করেছিল। তবে সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী- সুপার স্টোরগুলো ভ্যাট রেয়াত সুবিধা প্রাপ্ত হয়েছে। ক্রেতাকে আর অতিরিক্ত টাকা ভ্যাট হিসেবে দিতে হবে না। ফলে বাজারে প্রতিযোগিতার বাজার শুরু হয়েছে। তেল, গুঁড়াদুধ, সাবান বিভিন্ন দৈনন্দিন বাজার করতে গেলে ক্রেতার যখন ২০০০ টাকা বিল হয়, তাকে আরো ১০০ টাকা মূসক হিসেবে দিতে হতো। এভাবে বাজার খরচের একটা অংশ সুপারস্টোরে খরচ হবার জন্য অনেকে সুপারস্টোর থেকে কেনাকাটা করতেন না। যদিও পরিষ্কার পরিচ্ছনতা, পরিবেশ ও কোয়ালিটি পণ্য থাকায় অনেকের পছন্দ সুপারস্টোর থেকে কেনাকাটা করা। মুদ্রাস্ফীতির এ সময়ে খরচ বাঁচানোর জন্য সুপারস্টোর থেকে কেনাকাটা করার ইচ্ছা থাকলেও সেটা করতেন না। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন হবে।
ভ্যাট প্রত্যাহারের ফলে সুপার স্টোরগুলো এখন মুদি দোকানগুলোর মতো করমুক্ত ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে। এর ফলে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে এবং ভোক্তাদের কাছে আরও প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে। বিশেষ করে স্বপ্ন, আগোরা, মিনা বাজার, ইউনিমার্ট সহ অন্যান্য সুপার স্টোরগুলো এর সুফল পাবে। তারা ইতিমধ্যে তাদের কাস্টমারদের ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছে যে, তাদের বাজার ভ্যাটমুক্ত।
বর্তমান সরকার বেশ কিছু পণ্যে ভ্যাট আরোপ করলেও, সুপারস্টোরে ক্রেতাদের জন্য অতিরিক্ত টাকা মূল্য সংযোজন কর হিসেবে না দেয়ার ঘোষণা শহুরে জনমনে কিছুটা স্বস্তি হবে।
আরো পড়ুন: ভ্যাট-শুল্ক বেড়েছে শতাধিক পণ্যে ও সেবায়
https://nbr.gov.bd/regulations/sros/vat-sros/eng
এখন থেকে সুপারস্টোরে ক্রেতাদের ভ্যাট দিতে হবে না
সাম্প্রতিক নিয়ম অনুযায়ী, সুপার স্টোরগুলোতে কেনাকাটা করার সময় গ্রাহকদের আর অতিরিক্ত ভ্যাট দিতে হবে না। পণ্যের গায়ে প্রিন্ট করা খুচরা মূল্যে কেনাকাটা করা যাবে। পণ্য মূল্যের গায়ে এম আর পি বা ম্যাক্সিমাম রিটেইল প্রাইস বা খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ মূল্য হিসেবে দাম লেখা থাকলেও, এতোদিন ক্রেতাদের ৫% অতিরিক্ত টাকা দেয়া লাগতো। ক্রেতাগণ এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, সরকারী সিদ্ধান্ত মোতাবে ভ্যাট বা ”মূল্য সংযোজন কর” বলে ক্রেতা সাধারণকে বুঝাতে হতো।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) এর ভ্যাট বিভাগের দ্বিতীয় সচিব (ভ্যাট আইন ও বিধিমালা) ব্যারিস্টার মো. বদরুজ্জামান মুন্সী স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তি গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়েছিল। তবে পরবর্তীর পর্যালোচনা আর সুপারস্টোর মালিকদের সাথে বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ক্রেতাদের নিকট হয়ে আর ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর আদায় করা হতো না। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, সুপারস্টোর মালিকদের পণ্যের প্রিন্ট করা খুচরা মূল্যে বিক্রয় করতে হবে, যেখানে ইতিমধ্যেই ১৫% ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তারা তাদের মূল্য সংযোজনের ওপর ভ্যাট প্রদান করবে এবং পূর্ববর্তী ধাপ থেকে ইনপুট ভ্যাট ক্রেডিট দাবি করতে পারবে।
এর আগে সুপার স্টোর কেনাকাটায় ভ্যাটের হার ১.৫%, ২%, এবং ৫% পর্যন্ত পরিবর্তিত হতো, যা পরবর্তীতে এ অর্থবছরে ৭.৫% নির্ধারণ করা হয়। তবে চেইন সুপার স্টোর মালিকদের আপত্তি এবং রাজস্ব বোর্ড-এর সাথে আলোচনার পর নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে।
রাজস্ব বোর্ড এখন প্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা পর্যালোচনা করছে, যেগুলো উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাটমুক্ত থাকলেও ব্যবসায়িক পর্যায়ে ভ্যাটের আওতায় ছিল, যাতে ভোক্তারা অতিরিক্ত করের বোঝা বহন করতে না হয়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিকদার রনি থাকেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় । তিনি জানান, সুপার স্টোর থেকে পণ্য কেনার সময় অতিরিক্ত ভ্যাট দেখে প্রায়ই অবাক হই। তার প্রশ্ন “কেন আমাকে দুইবার ট্যাক্স দিতে হয়?” । বেশিরভাগ পণ্যের মোড়কে ১৫% ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত থাকে। সুপার স্টোরে অতিরিক্ত ৫% ভ্যাট দিতে হয়। রনি বলেন, “আমরা ক্রেতারা কখনো কখনো না জেনেই একই পণ্যের জন্য দুইবার ভ্যাট দিই।” তবে নতুন নিয়মের ফলে এই ধরনের দ্বৈত কর পরিশোধের সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে।
সুপার স্টোরগুলো সাধারণত মানসম্পন্ন এবং ব্র্যান্ডেড পণ্য সরবরাহ করে, যেখানে মুদি দোকানগুলোতে স্থানীয় এবং আনব্র্যান্ডেড পণ্যের প্রাধান্য বেশি। এখন সম প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে সুপার স্টোরগুলো পণ্যের মান ও সেবার মান আরও উন্নত করতে বাধ্য হবে।
মুদি দোকান এবং কাঁচাবাজারগুলোর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তারা যদি নিজেদের পণ্যের মান ও সেবার মান উন্নত করতে না পারে তবে তারা ক্রমশ ক্রেতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে। বিশেষ করে শহুরে এলাকায় ক্রেতারা এখন সুপার স্টোরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। সুপারস্টোরগুলোতে আলু, পেঁয়াজ সহ সব পণ্য নিজে দেখে পছন্দ মতো কিনে নিতে পারেণ এছাড়া সুপারস্টোর গুলোতে ক্রেডিট কার্ড, বিকাশ সহ নানান ডিজিটাল পেমেন্ট সুবিধা থাকে। কিছু ক্রেডিট কার্ড এ ক্যাশ ব্যাক অফার থাকে। এছাড়া সুপারস্টোরগুলোতে বিভিন্ন কোম্পানীর প্রমোশনাল অফার থাকেই। যার জন্য সুপারস্টোরগুলোতে বাজার করা অনেকের পছন্দ। এখন একই ছাদের নিচে সব ধরনের পণ্য পাওয়া গেলে ক্রেতা সবসময় বাড়বে বলে আশা করা যায়।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ক্রেতার নিকট হতে অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহারের ফলে সুপার স্টোরগুলোর বিক্রি বাড়বে। তারা ব্যবসার প্রসারে নতুন বিনিয়োগ করতে পারবে। তবে এটি স্থানীয় মুদি দোকানগুলোর জন্য একটি বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করবে, যারা কম মূলধন এবং সীমিত ব্যবসায়িক কাঠামোর মধ্যে কাজ করছে।
সর্বশেষে, ভ্যাট প্রত্যাহারের ফলে সুপার স্টোর ও মুদি দোকানের মধ্যে সম প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এটি ভোক্তাদের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে, কারণ তারা এখন আরও মানসম্পন্ন এবং সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে পারবেন। তবে মুদি দোকান ও কাঁচাবাজারগুলোর টিকে থাকতে হলে তাদের ব্যবসায়িক কৌশল ও মান উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।