
ঢাকা (১, নভেম্বর): বিশিষ্ট ইসলামি বক্তা ড. জাকির নায়েকের আসন্ন বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে দেশে-বিদেশে আলোচনা জোরদার হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার তাকে ২০২৫ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে ধর্মীয় আলোচনায় অংশ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। সরকারের তরফে বলা হয়েছে, এটি একটি ধর্মীয় সফর, যার উদ্দেশ্য শান্তি, মানবতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা বিষয়ে আলোচনা বিস্তার করা।
আয়োজকদের মতে, ড. নায়েক একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইসলামি বক্তা, যিনি বিশ্বের নানা দেশে শান্তি ও নৈতিক মূল্যবোধের আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে তিনি তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্তি থেকে ফিরিয়ে আনতে এবং যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোকে ইসলামী জ্ঞানচর্চা প্রসারে ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে তারা বিশ্বাস করেন। আয়োজক সংগঠনের এক মুখপাত্র বলেন, “ড. নায়েক যেভাবে যুক্তিসংগতভাবে ধর্মীয় বিষয় ব্যাখ্যা করেন, তা তরুণদের মাঝে ভাবনার নতুন দিক খুলে দেয়। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ সফর দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
অন্যদিকে, এই সফর নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে উদ্বেগও দেখা দিয়েছে। ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) নায়েকের বিরুদ্ধে উগ্রবাদে প্ররোচনার অভিযোগে মামলা করেছে এবং তাকে পলাতক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশ যেন সফরের সময় নিরাপত্তা ও আইনগত বিষয় যথাযথভাবে বিবেচনা করে।
২০১৬ সালের হলি আর্টিজান হামলার পর তৎকালীন সরকার ড. জাকির নায়েকের পরিচালিত প্রচার মাধ্যম ‘পিস টিভি’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তার সফরের অনুমতি দেওয়াকে অনেকেই পূর্ববর্তী নীতির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন। আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামিক বক্তা হিসেবে খ্যাতি পাওয়া ৬০ বছর বয়সী এই ধর্মপ্রচারক ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভারতে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে ‘ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচার’ ও অর্থপাচারের অভিযোগে একাধিক মামলা দায়ের হয় এবং তার চ্যানেল ‘পিস টিভি’র সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব ঘটনার পর তিনি ২০১৬ সালে ভারত ত্যাগ করে মালয়েশিয়ায় চলে যান এবং সেখানে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি লাভ করেন। ভারতে প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে একাধিকবার তিনি জানিয়েছেন, “ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত আমি ভারতে ফিরব না।” বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করায় তিনি ভারতের বিচারিক প্রক্রিয়ার বাইরে রয়েছেন। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “ড. জাকির নায়েক একজন পলাতক আসামি এবং তিনি ভারতে ওয়ান্টেড। আমরা আশা করি, তিনি যে দেশেই যান না কেন, সংশ্লিষ্ট সরকার তার বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে এবং ভারতের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত উদ্বেগগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।” বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, সফরটি সামাজিকভাবে সংবেদনশীল হলেও প্রশাসনিক প্রস্তুতি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় এর নিরাপদ আয়োজন সম্ভব।
ধর্মীয় বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, নায়েকের যুক্তিনির্ভর বক্তৃতা অনেক তরুণকে ইসলামি জ্ঞানে আগ্রহী করেছে, এবং তিনি ইসলামের সার্বজনীন বার্তা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের মতে, তার বক্তব্যকে কেবল বিতর্কের চোখে দেখা ঠিক নয়; বরং তার শিক্ষণীয় দিকগুলো নিয়ে গবেষণা ও আলোচনা হওয়া উচিত।
তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সফরের প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের বহুত্ববাদী সমাজে যেকোনো ধর্মীয় বক্তৃতা যেন বিভাজন বা উসকানির জন্ম না দেয়, সে বিষয়ে সরকারকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, জাকির নায়েকের সফর শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত ঢাকায় প্রথম বক্তৃতার স্থান ও তারিখ চূড়ান্ত হলেও অন্য শহরের সময়সূচি প্রকাশ করা হয়নি। স্পার্ক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের আয়োজনে আগামী ২৮ ও ২৯ নভেম্বর জাকির নায়েকের এই অনুষ্ঠানটির স্থান হতে পারে আগারগাঁও এলাকায়।
নেতিবাচক ও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মাঝেও সফরটি বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিসরে নতুন এক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আয়োজকদের আশা, এটি যুক্তি, শান্তি ও মানবতার বার্তা ছড়ানোর এক মঞ্চ হয়ে উঠবে, আর সমালোচকদের মতে, এর প্রভাব সমাজে কতটা ইতিবাচক হবে তা নির্ভর করবে বক্তৃতার বিষয়বস্তুর ওপর।