
বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে দালালচক্র, নথি জালিয়াতি ও কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ গভীর সংকটে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে দালাল ও প্রতারণামুক্ত, সুশাসনভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেন তিনি।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ও জাতীয় প্রবাসী দিবস–২০২৫ উপলক্ষে বুধবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিদেশগমন এখন বিপজ্জনকভাবে দালাল ও প্রতারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অর্থবহ অগ্রগতি হয়েছে—এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত হয়নি বলেও তিনি স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, অনেক উদ্যোগ বাইরে থেকে আকর্ষণীয় মনে হলেও সরকার এখনো দালালনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মূল কাঠামোর ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। বিশ্বের যে কোনো দেশে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের ক্ষেত্র কার্যত দালালনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে, যেখানে আর্থিক লেনদেনের প্রকৃত হিসাব বোঝা প্রায় অসম্ভব।
গ্রামীণ ব্যাংকের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, গ্রামাঞ্চলের নারীরা সন্তানদের বিদেশে পাঠাতে ঋণের জন্য আবেদন জানাতে শুরু করলে প্রথম দালালচক্রের বাস্তব চিত্র তার সামনে আসে। রেমিট্যান্স আয়ের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে এই বাস্তবতা যে কোনো মূল্যে বদলাতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নথি জালিয়াতির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভুয়া কাগজপত্রের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ হয়েছে, এমনকি বিদেশি বন্দরে বাংলাদেশি নাবিকদের জাহাজ থেকে নামতে না দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এটিকে তিনি ‘বেদনাদায়ক বাস্তবতা’ হিসেবে আখ্যা দেন।
তবে সরকারের উদ্যোগে কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে এবং ধীরে ধীরে কয়েকটি দেশের দরজাও খুলছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।
বিশ্বজুড়ে শ্রমিক চাহিদার সুযোগ কাজে লাগাতে না পারায় বাংলাদেশ বড় সম্ভাবনা হারাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু জাপানই কয়েক লাখ শ্রমিক নিতে প্রস্তুত। চলতি বছর জাপান সফরের সময় আগামী পাঁচ বছরে এক লাখ বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর প্রস্তাব দিলে দেশটি তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, ‘আজ যদি আমরা পাঁচ লাখ মানুষ পাঠাতে চাই, জাপান তাদেরও নেবে। প্রধান শর্ত ভাষা ও কারিগরি দক্ষতা।’
বাংলাদেশকে ‘যুবাদের সোনার খনি’ আখ্যা দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দেশের প্রায় ৯ কোটি মানুষ ২৭ বছরের নিচে। বিশ্ব আজ তরুণ খুঁজছে। এই তরুণরা তেল বা খনিজের চেয়েও বেশি মূল্যবান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। স্বাগত বক্তব্য দেন সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া।
অনুষ্ঠানে তিন ক্যাটাগরিতে ৮৬ জন প্রবাসী বাংলাদেশিকে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) সম্মাননা দেওয়া হয়। পাশাপাশি প্রবাসী কর্মীদের জন্য বীমা সুবিধা, চিকিৎসা সহায়তা, আর্থিক অনুদান, ক্ষতিপূরণ এবং মেধাবী সন্তানদের জন্য বৃত্তির চেক বিতরণ করা হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভূমিকা ও অর্থনীতিতে তাদের অবদান নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।