যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ৩১ জুলাই রাতে ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউস থেকে এই সিদ্ধান্তের ঘোষণা আসে, আর আজ ১ আগস্ট থেকেই কার্যকর হয়েছে নতুন হার। এই সিদ্ধান্ত এসেছে দীর্ঘ এক মাসব্যাপী আলোচনা, চিঠিপত্র, কৌশলগত লেনদেন এবং উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক তৎপরতার পর।
মূল ঘটনা শুরু হয় ২ এপ্রিল, যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হঠাৎ করেই বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। আগে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক ছিল, সেখানে এক লাফে প্রায় দ্বিগুণের বেশি করে ৩৭ শতাংশ শুল্ক বসিয়ে দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুক্তি ছিল, বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে, তাই দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষিত করতে পাল্টা শুল্ক জরুরি।
এই ঘোষণার ফলে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাত—তৈরি পোশাক—গভীর অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রায় ৮৪০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যার সিংহভাগই তৈরি পোশাক। শুধু গত অর্থবছরেই ৭৩৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয় মার্কিন বাজারে। এই বাজারের ওপর অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দিলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র ৯ এপ্রিল থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত ৯০ দিনের শুল্ক বিরতি ঘোষণা করে, যাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি যৌক্তিক চুক্তিতে পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশ এই সুযোগকে কাজে লাগাতে উচ্চপর্যায়ের একাধিক আলোচনা শুরু করে। ৮ জুলাই, বিরতির একদিন আগে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি চিঠিতে জানিয়ে দেন যে, বাংলাদেশের জন্য শুল্ক ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ওই হারও বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক ছিল, কারণ ১৫ শতাংশ থেকে এক লাফে ৩৫ শতাংশে পৌঁছানো মানে পণ্যের প্রতিযোগিতামূল্য নষ্ট হওয়া। তাই বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও আলোচনায় বসে এবং পাল্টা কিছু ‘অফার’ দেয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ২৫টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, বোয়িং কোম্পানির কাছ থেকে এই ২৫টি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত সরকারের পরিকল্পনার অংশ ছিল, তবে নতুন শুল্ক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সেটিকে দ্রুত কার্যকর করা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ ১৪টি বোয়িংয়ের অর্ডার দিয়েছিল। এবার সংখ্যাটি বাড়িয়ে ২৫-এ উন্নীত করা হয়। বোয়িং কোম্পানির সঙ্গে এই অর্ডার বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি বিমান পরিবহন পরিকল্পনারও অংশ, কারণ জাতীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমানের বহর সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা আগেই নির্ধারিত ছিল।
এই অর্ডার ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাড়তি দামে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার, যা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় একটি ‘গুডউইল’ বা সদিচ্ছার বার্তা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
শুল্ক আলোচনার চূড়ান্ত পর্ব হয় ৩০ ও ৩১ জুলাই ওয়াশিংটনে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল আলোচনায় অংশ নেয়। দলে ছিলেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন ইউএসটিআর-এর (United States Trade Representative) বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ।
এছাড়া দুই দেশের মধ্যে অনলাইন বৈঠক, আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা এবং শুল্ক চুক্তির খসড়া নিয়ে বারবার মতবিনিময় চলে। বাংলাদেশ ২৩ জুলাই নিজেদের চূড়ান্ত অবস্থান জানিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রকে, যেখানে সব খসড়ার জবাব ও মন্তব্য পাঠানো হয়। এই ধারাবাহিক আলোচনা শেষে ৩১ জুলাই রাতে হোয়াইট হাউস থেকে ঘোষিত হয় নতুন হার—২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক।
হোয়াইট হাউসের এই ঘোষণায় বাংলাদেশ ছাড়াও আরও ২৫টির বেশি দেশের ওপর শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়। ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার ওপর ১৯ থেকে ২০ শতাংশ, মিয়ানমারের ওপর সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আফগানিস্তান, কঙ্গো, কম্বোডিয়া, আইভরি কোস্ট, ইকুয়েডরসহ আরও বহু দেশের ওপর ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত নতুন পাল্টা শুল্ক বসানো হয়েছে।
নতুন শুল্ক হার কার্যকর হওয়ার পর এখন থেকে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশমূল্য হবে ১৫ শতাংশ সাধারণ শুল্ক এবং ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক—মোট ৩৫ শতাংশ। যদিও এটি আগের ৩৭ শতাংশের চেয়ে কম, তবে এখনও আগের ১৫ শতাংশ হারের তুলনায় অনেক বেশি।
এদিকে শুল্ক ঘোষণার প্রভাব পড়ে এশিয়ার শেয়ারবাজারেও। দক্ষিণ কোরিয়ার কসপি সূচক পড়ে যায় ৩.১ শতাংশ, জাপানের নিক্কেই সূচক পড়ে ০.৪ শতাংশ। ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলো রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দিয়েছে ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি ও মূল্যছাড় কমে যাওয়ায়।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য ২০ শতাংশ হার কিছুটা স্বস্তির হলেও, বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন—এই ছাড়কে কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশকে এখনই প্রস্তুত থাকতে হবে উৎপাদন খরচ কমানো, নতুন বাজারে প্রবেশ এবং পণ্যের মান বজায় রাখার দিকগুলোতে।