
বরফে ঢাকা উঁচু পাহাড়ি পথ, গিরিখাদে ফসকানোর সম্ভাবনা, অক্সিজেনের কম থাকা, তীব্র ঠাণ্ডা, অনিশ্চিত ভূমিধ্বস—এইসব ঝুঁকি সত্ত্বেও কুমিল্লার ৪১ বছর বয়সী অভিযাত্রী আরিফুর রহমান উজ্জল সাহসিকতার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি মাত্র একটিই নয়, হিমালয়ের তিনটি চ্যালেঞ্জিং ট্রেকিং রুট—মানাসলু সার্কিট, অন্নপূর্ণা সার্কিট এবং এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের তিনটি পাস ট্রেইল—সাইকেলে অতিক্রম করে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ইতিহাস গড়ে তুলেছেন।
উজ্জল ৭ সেপ্টেম্বর নেপালের কাঠমান্ডু থেকে যাত্রা শুরু করেন। মোট ৮২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয় তাকে। এই পথের বড় অংশ ছিল বরফ, কাদা ও পাথরে ঢাকা। কখনো কখনো খাড়া ঢাল, কখনো অক্সিজেন স্বল্পতা, কখনো হঠাৎ ভূমিধ্বসের ভয়—সব কিছু মিলিয়ে এটি ছিল মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ অভিযান।

প্রথমে তিনি মানাসলু সার্কিট অতিক্রম করেন। ১৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রুটে তাকে ১১ দিন সময় লেগেছে। বরফে ফসকানো, ঝুঁকিপূর্ণ খাড়া ঢাল, গভীর গিরিখাদ—প্রত্যেক ধাপে মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল। এরপর অন্নপূর্ণা সার্কিটে যাত্রা করেন, যা ৩০৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই রুটে তুলনামূলকভাবে কিছুটা স্বস্তিতে সাইকেল চালানো গেছে, তবে বরফ-ছেঁড়া পাহাড়ি রাস্তা ও ভূমিধ্বসের সম্ভাবনা ছিল সেখানে থেকেও।
সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশ ছিল এভারেস্ট অঞ্চলের তিনটি পাস—কংমা লা, চো লা ও রেঞ্জো লা। বিশেষ করে কংমা লা পাসে মৃত্যুর ঘটনার হার অনেক বেশি। তীব্র ঠাণ্ডা, অক্সিজেন কম, ফ্রস্টবাইট এবং ক্র্যাম্প—সব কিছুর মধ্যেও উজ্জল মনোবল হারাননি। বরফে ঢলে নেমে আসার সময় চোখে পড়া অপরূপ দৃশ্য তাকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত করেছে। সাত কেজি ওজনের ব্যাগ এবং ১০ কেজি ওজনের সাইকেল একসঙ্গে কাঁধে তুলে পাহাড় চড়তে হয়েছে তাকে। রাতে তীব্র শীতে ঘুমাতে না পারা, ঠান্ডায় হাত-পায়ে ফ্রস্টবাইট—সব কিছুর মধ্যেও সে হাল ছাড়েননি।
উজ্জল জানিয়েছেন, এই অভিযান কেবল সাইকেল চালানোর নয়, মাঝে মাঝে ট্রেকিং করতেও হয়েছে। হঠাৎ সাইকেল নিয়ে এই রুটে ওঠা কারোর পক্ষে সম্ভব নয়; এটি করার জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ প্রস্তুতি প্রয়োজন। তার শৈশব ময়নামতির লালমাই পাহাড়ের কাছে কাটে, যার কারণে পাহাড়ের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক। ২০০৩ সালে বান্দরবন ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ে উঠার অভিজ্ঞতা তার সাহসিকতার ভিত্তি গড়ে তোলে।
বাংলাদেশ দূতাবাস কাঠমান্ডু তাকে সংবর্ধনা দিয়েছে। রাষ্ট্রদূত মো. শফিকুর রহমান বলেছেন, উজ্জলের এই অর্জন দেশের তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হবে। তিনি বলেন, “পরিশ্রম এবং পরিকল্পনা থাকলে কিছুই অসম্ভব নয়। তরুণরা চাইলে এমন অভিযান করতে পারে, তবে প্রথমে মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে।”
উজ্জল পেশায় একজন পর্যটন ব্যবসায়ী। সময় পেলেই স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে ভ্রমণ করেন। তিনি বলেছেন, এই অভিযান শুধু নিজের জন্য নয়, দেশের জন্যও কিছু করার ইচ্ছা তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। প্রতিটি ধাপ, প্রতিটি ঝুঁকি তাকে শিখিয়েছে—সাহস, ধৈর্য, পরিকল্পনা এবং লক্ষ্য নির্ধারণের গুরুত্ব। এই অভিযানে উজ্জল দেখিয়েছেন, কঠিন লক্ষ্য অর্জন সম্ভব, যদি থাকে দৃঢ় সংকল্প ও সঠিক প্রস্তুতি।
উজ্জলের এই অভিযানের নাম ‘দুরন্ত হিমালয় এক্সপিডিশন’, যার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন দেশীয় বাইসাইকেল ব্র্যান্ড দুরন্ত। তার সাফল্য কেবল ইতিহাস নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য গর্ব এবং দেশের যুবসমাজের জন্য শক্তিশালী অনুপ্রেরণা।
